ঝরেপড়া সুপারি গাছের খোল দিয়ে ওয়ান টাইম পণ্য তৈরি করে ভারতে তামিলনাড়ুর এক দম্পতির সচ্ছল হওয়ার গল্প ফেসবুক পোস্ট দেখে টাঙ্গাইলের কামরুল হাসান নাহিদের জীবনের পরিবর্তন ঘটে। তখন থেকে তার জীবনের গল্পও শুরু। পরিবেশবান্ধব এসব পণ্যের প্রচার-প্রসারে জন্য সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন জেলা প্রশাসক মো. কায়সারুল ইসলাম।
জানা যায়, টাঙ্গাইলের কামরুল হাসান নাহিদ ঢাকা থেকে টেক্সটাইল থেকে বিএসসি পাসের পর মার্চেন্ডাইজার হিসেবে দুবছর চাকরি করেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই দেখা দেয় মহামারি করোনা। সে সময় চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন তিনি। নিজের মোবাইল মাধ্যমে ফেসবুক দেখতে দেখতে হঠাৎ এক ফেসবুক পোস্টে তার চোখে পড়ে ঝরে পড়া সুপারি পাতার খোল থেকে মেশিনে পরিবেশবান্ধব ওয়ান টাইম পণ্য তৈরি করে ভারতের তামিলনাড়ুর এক দম্পতি। সেখান থেকেই কামরুল হাসান নাহিদের আগ্রহ বেড়ে যায়। এর পর পরিবারের সঙ্গে পরামর্শ করে চাকরি ছেড়ে গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার বাগবাড়িতে চলে আসেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই তামিলনাড়ুতে গিয়ে আট লাখ টাকায় একটি মেশিন ক্রয় করে আনেন। মেশিনটির জন্য প্রয়োজনীয় স্থাপনা তৈরি করতে খরচ করেন আরও প্রায় চার লাখ টাকা। এদিকে মেশিন বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি মেশিনের সঙ্গে গিয়ে হাতে-কলমে দেখিয়ে দিয়ে যান কীভাবে তৈরি করতে হয় সুপারি পাতার খোল থেকে নানা রকমের পণ্য। এরপর পাতা সংগ্রহ করে শুরু করেন পণ্য তৈরির কাজ।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভুয়াপুর উপজেলার বাগবাড়ি গ্রামে পাকা রাস্তার সঙ্গে নাহিদের কারখানা। কারখানার নাম 'ইকো বাজার'।এই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির ওয়ান টাইম প্লেট, বাটি, ট্রে, ফুড বক্সসহ পরিবেশবান্ধব পণ্য। এগুলোর দাম ছয় থেকে ১২ টাকার মধ্যে। নাহিদের কারখানা ইতোমধ্যেই প্রায় দুই বছর হয়েছে। গ্রামের কয়েকজনকে কাজটি শিখিয়ে কারখানায় খণ্ডকালীন নিয়োগ দিয়েছেন নাহিদ। তাদেরই একজন স্থানীয় কলেজছাত্র শিমুল। কারখানায় সুপারি গাছের পাতার খোল থেকে তৈরি পণ্যগুলো স্থানীয়ভাবে স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সচেতন রেস্টুরেন্ট বা রিসোর্ট মালিক বা ক্রেতাদের কাছে চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করছে। এরমধ্যে ২০ হাজার প্লেট এক রপ্তানিকারকের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছে।
শিমুল কালবেলাকে বলেন, কারখানায় দিনে এক হাজার থেকে ১২শ প্লেট তৈরি করা যায়। সুপারি গাছের খোলটি ভালো করে ধুয়ে নেই। এতে খোলটির উপরে কোনো ধরনের ময়লা থাকলে পরিষ্কার হয়ে যায়। তাছাড়াও খোলটি যখন পণ্য তৈরিতে ডাইসে দেওয়া হয় তখন পণ্যটি ভালোভাবে উঠে যায়। অর্ডার এলে আমরা কাজে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আবার অর্ডার না থাকলে বসে থাকতে হয়। তাই নিয়মিত অর্ডার থাকলে লোকবল বেশি থাকত, কাজের গতি বাড়ত। এক কথায় প্রচারণায় বেশি করে পণ্যের চাহিদা এবং পাশাপাশি সরকারিভাবে সহায়তা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই কর্মচারী।
স্থানীয় শিল্পী হাসান কালবেলাকে বলেন, প্রথম দিকে আমাদের বাড়ির লোকজনের চাহিদা অনুযায়ী প্লেট ও বাটি কারখানা থেকে ক্রয় করে এনেছি। আবার আমাদের আত্মীয় যারাই বেড়াতে যায় তারাও তাদের চাহিদা অনুযায়ী ক্রয় কবে নেন। তবে তিনি মনে করেন দামটা একটু বেশি হচ্ছে।
কারখানার আরেক কর্মচারী হাসেম বলেন, তাদের বিশ্বাস প্রয়োজনীয় প্রচারের অভাবে এসব পণ্যের তেমন প্রসার ঘটেনি। ভালোভাবে প্রচার করা হলে দেশে ও বিদেশে পরিবেশবান্ধব এসব পণ্যের বাজার সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন এই কর্মচারী।
কামরুল হাসান নাহিদ কালবেলাকে জানান, তামিলনাড়ুতে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ তাই সেখানে বিকল্প হিসেবে সুপারি পাতার খোল দিয়ে বানানো ওয়ান টাইম পণ্য বেশ জনপ্রিয়। সেখানকার পরিবারগুলো বছরে প্রায় ৮০০ কোটি রুপির পণ্য রপ্তানি করে থাকেন। আমাদের দেশে প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম প্লেট বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ক্রয় করে থাকেন। সেটি না ব্যবহার করে আমার এই সুপারি গাছের খোল থেকে যে প্লেট তৈরি করছি সেটি বেশি বেশি ক্রয় করেন। এই প্লেট দেখতেও ভালো। তাছাড়াও প্লেটটি যত্নে রাখলে অনেক দিন ব্যবহার করতে পারবেন।
তিনি জানান, কারখানা করার আগে চাকরি নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তায় ছিলাম। এখন আমি যদি সরকারিভাবে কোনো ধরনের সহযোগিতা পেতাম তাহলে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের জায়গা তৈরি করতে পারতাম। তাছাড়াও পণ্যগুলো বিদেশে রপ্তানি করার জন্য সহযোগিতা চাই সরকারের কাছে। ফেসবুকে তামিলনাড়ুতে এক দম্পতির সফলতা দেখে আমি করেছি। সে যদি সফল হতে পারে তাহলে আমার দেশের মানুষ আমাকে সফলতার জন্য সার্বিক সহযোগিতা করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তাই সরকারের কাছে দাবি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার জন্য সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি বিদেশে পণ্যগুলো বিক্রি করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার। এ ছাড়াও আমাদের দেশে কয়েকটি জেলায় কয়েকজন উদ্যোক্তা ছোট পরিসরে এসব পণ্য তৈরি করছেন। তাদের মধ্যে কারো কারো পণ্য তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে বিদেশেও যায়। আমাদের কাঁচামাল সংগ্রহ করতে অনেক কষ্ট করতে হয়। স্থানীয়ভাবে এসব সংগ্রহ করা কমই হয়। কক্সবাজার, ভোলাসহ কয়েকটি জেলার সুপারি বাগান থেকে বেশিরভাগ খোল সংগ্রহ করা হয়।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, পরিবেশবান্ধব এসব পণ্যের প্রচার-প্রসারের জন্য সার্বিক সহযোগিতা করা হবে। আমরা অবশ্যই উনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করার চেষ্টা করব।
মন্তব্য করুন