শাহীন আলম, দেবিদ্বার (কুমিল্লা) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২৪, ০২:২৯ পিএম
আপডেট : ৩০ জুলাই ২০২৪, ০২:৩৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

‘আমার নিমাই চাঁনরে কেউ আইন্না দাও, আমি জড়াই ধরি’

মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে কাদির হোসেন সোহাগকে দেখিয়ে তার মা নাছিমা বেগম। : কালবেলা
মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে কাদির হোসেন সোহাগকে দেখিয়ে তার মা নাছিমা বেগম। : কালবেলা

‘আমার কলিজার টুকরো ছেলেটা কই, আমার নিমাই চাঁনরে গুলি করে মারল কে? আমার বুকটা খালি করল কারা? তাদের কী একটুও বুক কাঁপল না! আমার ছেলেরে কেউ আইন্না দাও, আমি জড়াই ধরি। না জানি আমার সোনার চানের কত কষ্টে দম গেছে, আহারে কোন পাষণ্ড আমার নিরীহ ছেলেরে গুলি করল, আমার চিকিৎসার খরচ আর কে দিবে। আল্লাহ, তুমি আমার বুক খালি করে কলিজার টুকরো ছেলেরে কীভাবে নিলা। আমার তো সব শেষ হয়ে গেছে।’

গণমাধ্যম কর্মীদের দেখে এভাবেই হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন ঢাকায় গুলিতে নিহত কাদির হোসেন সোহাগের মা নাছিমা বেগম। গত ২০ জুলাই রাজধানীর গোপীবাগ এলাকায় সংঘর্ষ চলাকালীন রাত ৮টার দিকে গুলিবিদ্ধ হন ২৪ বছরের সোহাগ।

কয়েকজন তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে রাত ৩টার পর তার মৃত্যু হয়। নিহত সোহাগ দেবিদ্বার উপজেলার ভানী ইউনিয়নের সূর্যপুর গ্রামের মৃত মোহাম্মদ আলীর ছেলে। সে ঢাকার গোপীবাগ এলাকায় একটি মেসে ভাড়া থাকত। ২১ জুলাই সকাল ১১টার দিকে তার মরদেহ গ্রামের বাড়ি সূর্যপুরে নিয়ে নিয়ে আসে। পরে দুপুরে জানাজা শেষে তাকে বাড়ির পাশে একটি কবরস্থানে দাফন করা হয়।

মা নাছিমা বেগম ছেলে সোহাগের ছবি দেখিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কালবেলাকে বলেন, ২২ বছর ধরে স্বামী নেই, সোহাগের যখন তিন বছর তখন আমার স্বামী ঢাকা থেকে নিখোঁজ হয়, আর ফিরে আসেনি। সে এখনও বেঁচে আছে না মরে গেছে আমরা কেউ জানি না। তবুও আমরা ধরে নিছি তিনি আর বেঁচে নেই। স্বামী নিখোঁজের পর সংসারের হাল ধরতে সোহাগ ও দেড় বছরের সহিদুল ইসলামকে নিয়ে ঢাকায় মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করেছি। পাঁচ বছর আগে অসুস্থ হলে পড়লে আমি গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। সোহাগ লেখাপড়া বন্ধ করে সংসারের হাল ধরে। ছোট ছেলে সহিদুল মাদ্রাসায় চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। অভাব অনটনে তার লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যায়, সে এখন এক বই বাধাই কোম্পানিতে কাজ করে।

তিনি চোখের পানি মুছেন আর বলেন, আমার চিকিৎসা ও সংসারের হাল ধরতে সোহাগ একটি কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিতে ডেলিভারি ম্যান হিসেবে কাজ করত। গত ১০ থেকে ১২ দিন আগে তার চাকরিটা চলে যায়। পরে নতুন আরেকটি কোম্পানিতে চাকরির কথা হয়। ১৫ জুলাই বাড়িতে এসে কাগজপত্র নিয়ে নতুন কোম্পানিতে জমা দেয়। এরপর ৪ থেকে ৫ দিনের মধ্যে নতুন চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রোববার আমার ছেলের বুকে গুলি লাগে।

আমি এখন কী নিয়ে বাঁচব আক্ষেপ করে নাছিমা বেগম বলেন, আমার ছেলে শেষবার আমাকে ফোন করে বলেছিল, ‘মা ঢাকায় অনেক গোলাগুলি হচ্ছে, অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে’ - এ কথা শুনে আমার বুকে কেঁপে উঠে। আমি বলি, বাবারে তুই রুম থেকে বের হইস না। ছেলে বলে, ‘না মা আমরা সব রুমমেট একসঙ্গে আছি, বের হইনি। তবে মা মেসে কোনো খাবার নেই, আমার কাছেও কোনো টাকা নেই, তুমি যদি পার আমার বিকাশে ৫০০ টাকা দিও। আর তুমি ঠিকমতো ওষুধগুলো খাইও।’ পরে আমি আমার ছেলের নম্বরের ৫০০ টাকা পাঠাই। ওই টাকা নিয়ে সন্ধ্যায় নাশতা আনতে বের হয়। আমি আমার ছেলের হত্যার বিচার কার কাছে চাইব। কেউ কি আমার ছেলেকে ফিরায় দিতে পারবে? বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন মা।

সোহাগের ছোট ভাই সহিদুল ইসলাম বলেন, ভাই গুলি খাওয়ার পর তার বন্ধুরা আমাকে ফোনে জানায়। আমি রাত ৩টার দিকে ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছাই, গিয়ে দেখি ভাইয়ের বুকে ব্যান্ডেজ করা। আমাকে দেখে ভাই বলে, তুই এত রাতে এখানে কেনো আসছিস। তুই মাকে দেখে রাখিস। এই কথা বলে রাত ৩টা ১৫ মিনিটের দিকে ভাই মারা যায়। ভাই একমাত্র আমাদের সংসার চালাত। বাবা ও ভাই হারিয়ে আমরা আজ নিঃস্ব হয়ে গেলাম।

নিহত সোহাগের চাচা এখলাছুর রহমান শানিক বলেন, ২২ বছর আগে সোহগের বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর তার মা বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ করে সন্তানদের বড় করেছেন। তার মা অসুস্থ হলে গেলে তার চিকিৎসার খরচ ও সংসারের হাল ধরে সোহাগ। নতুন একটি কোম্পানিতে চাকরির কথা চলছিল তার। দুই একদিনের মধ্যে সেখানে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। সেটা আর হলো না। ছোটবেলা থেকে বাবার আদর পায়নি ছেলেটা, অভাব অনটনে বড় হইছে। ধরতে গেলে ওরা এতিম ছিল। একটা গুলি এই পরিবারটাকে একবারে পথে বসিয়ে দিল।

ভানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী জালাল উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ছেলেটা কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। সংসারটা সেই চালাত। ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে সে মারা যায়। এটি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। আমি পরিষদ থেকে তার মাকে বিধবা ভাতার কার্ড করে দেব।

দেবিদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিগার সুলতানা বলেন, এটি একটি মর্মান্তিক মৃত্যু। তার পুরো পরিবার সম্পর্কে আমি খোঁজখবর রাখছি। সরকারিভাবে সোহাগের মাকে সাহায্য সহযোগিতা করা হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
ঘটনাপ্রবাহ: কোটা সংস্কার আন্দোলন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

যশোরে বিএনপি অফিস ভাঙচুর, আ.লীগের ৬৩ নেতাকর্মীর নামে মামলা

হবিগঞ্জে নির্ধারিত সময় শেষেও জমা পড়েনি ৩১টি অস্ত্র

নওগাঁয় দুই সাংবাদিককে তুলে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন

আহাজারি থামছেই না নিহত মাসুদের মায়ের

‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৪৯ শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে’

রাজশাহীতে মাসুদ হত্যা নিয়ে আ.লীগের বিবৃতি

লাইফ সাপোর্টে মুস্তাফা মনোয়ার

দুঃসংবাদ দিল আবহাওয়া অফিস

শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার বিষয়ে ঢাবি শিক্ষকদের মতবিনিময় আজ

মেঘনার গর্ভে বিলীন ২০টি বাড়ি

১০

রিমার্ক-হারল্যানে মেহেদী মিরাজকে উষ্ণ অভ্যর্থনা

১১

যুবদল নেতা নয়নকে অব্যাহতির বিজ্ঞপ্তি ভুয়া

১২

অফিস শেষে বাড়ি ফেরা হলো না হাসান-মাসুমের

১৩

এক কমেন্টেই শিক্ষা জীবন শেষ নোবিপ্রবি শিক্ষার্থীর 

১৪

বগুড়ায় ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে খুন

১৫

পাটগ্রাম সীমান্তে বিজিবির উদ্যোগে রাস্তা নির্মাণ

১৬

মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারকে লাঞ্ছিত করলেন যুবদল নেতা

১৭

নেতাকর্মীদের প্রতি বিএনপির বিশেষ বার্তা

১৮

জোরপূর্বক প্রধান শিক্ষকের রুমে তালা, যুবদল-ছাত্রদল নেতা আটক

১৯

ট্রাক শ্রমিকের মৃত্যু / নোয়াখালীতে একরামুলসহ ৫৩ আ.লীগ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা

২০
X