গাজীপুরের কালিয়াকৈরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে অপারেশনের প্রায় এক বছর পর এক নারীর পেট থেকে বের করা হলো রক্ত মোছার গজ ও সুই। এই দীর্ঘ সময়ে গজটি ওই নারীর পেটের নাড়ির সঙ্গে মিশে যায় এবং তাতে পচন ধরে তার জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে।
অপারেশনটি করা হয়েছিল কালিয়াকৈর উপজেলার সদরে অবস্থিত দেওয়ান ডিজিটাল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার লিমিটেড নামক একটি হাসপাতালে।
প্রসূতির পরিবার ও একাধিক সূত্রে জানা যায়, উপজেলার গোয়ালবাথান গ্রামের মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী সম্পা আক্তার (২৫) প্রসব ব্যথা শুরু হলে গত ২০২২ সালের ১৯ আগস্ট তাকে কালিয়াকৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসা হয়। এ সময় প্রসূতি বিভাগের কর্মরত গাইনি ডাক্তার কুহু মুৎসুদ্দীকে দেখালে তিনি দেওয়ান ডিজিটাল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যেতে বলেন। সেখানে তিনি সিজার করবেন বলে জানান। পরে কালিয়াকৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গাইনি ডাক্তার কুহু মুৎসুদ্দি ওই হাসপাতালে সম্পার সিজার করেন।
অপারেশনে সম্পা এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। এটি তার তৃতীয় সন্তান ছিল। কিন্তু জন্মের পরের দিন সেই কন্যা সন্তানের মৃত্যু হয়।
সিজারের পর সম্পার অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে ওই হাসপাতাল থেকে রেফার করে পার্শ্ববর্তী মির্জাপুর উপজেলার কুমুদিনী মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে তিনদিন চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু বাড়িতে যাওয়ার পর থেকেই তার পেট ব্যথাসহ নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। পেট ফুলে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হলে সম্পাকে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর সম্পার পেটে রক্ত মোছার গজ ও সুই দেখা যায়। ওই হাসপাতালে গজ ও সুই বের করার জন্য আরও পাঁচবার অপারেশন করা হয়। সেখানে চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ অনুভব করলে পরবর্তীতে আবার পেট ব্যথা শুরু করে। এবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে এক চিকিৎসকের পরামর্শে পপুলার হাসপাতালের ধানমন্ডি শাখায় সিটি স্ক্যান করা হয়। সিটি স্ক্যানের রেজাল্ট আসলে দেখা যায় আরও একটি সুই গভীরে রয়ে গেছে এবং সঙ্গে কিছু গজও আছে। এমতাবস্থায় সম্পার ছয়বার অপারেশন হওয়ার কারণে পরবর্তীতে অপারেশন করতে অপারগতা প্রকাশ করে চিকিৎসকরা। বর্তমানে সম্পাকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় এক বছর ধরে পেটের ভিতর গজ ও সুই নিয়েই অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে প্রতিনিয়তই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বেঁচে আছেন তিনি।
এই ভুল চিকিৎসা বা ডাক্তারের অবহেলার কারণে কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর ভুক্তভোগীর স্বামী মোহাম্মদ আলী সুষ্ঠু বিচার চেয়ে একটি আবেদন করেন।
আরও পড়ুন : ৯১ টাকার স্যালাইন ২০০ টাকা
সম্পার স্বামী মোহাম্মদ আলী বলেন, 'উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে ডাক্তার কুহু মুৎসুদ্দিকে দেখালে তিনি আমাদের দেওয়ান হসপিটালে পাঠান। সেখানে আমার স্ত্রীকে সিজার করার পর আমার নবজাতক কন্যাকে বাঁচাতে পারেনি এবং আমার স্ত্রীর অপারেশনের পর সুই ও গজ পেটের ভিতরে রেখেই সেলাই করে দেন। সিজারের পর আমার স্ত্রীর অনেক পেটে ব্যথা হয় এবং বমি করে, পেট ফুলে যায়। একপর্যায়ে সেলাইও ফেটে যায়। এই বিষয়গুলো নিয়ে ডাক্তার কুহু মুৎসুদ্দির কাছে আসলে তিনি আমাদের পাত্তা দেয় না। রোগীকে বাঁচানোর জন্য আমরা ফজিলাতুন্নেছা হসপিটালে ভর্তি করাই সেখানে গিয়ে দেখতে পারি পেটের ভিতর গজ ও সুই আছে।
রোগী সম্পা আক্তার বলেন, ‘কুহু ম্যাডাম আমাকে অপরেশন করে আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে। আমি বাঁচতে চাই। আমার দুই সন্তান নিয়ে আমি আপনাদের মাঝে বাঁচতে চাই, আমাকে বাঁচান। আমার চোখের সামনে ম্যাডাম আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলেছে। কুহু ম্যাডাম আমার মেয়েকে আমাকে দেখতেও দেয় নাই। আমি কুহু ম্যাডামের বিচার চাই।’
সম্পার ভগ্নিপতি বলেন, ‘আমরা যাওয়ার আগেই কুহু ম্যাডাম দেওয়ান ক্লিনিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়ায় সিজার করে। পরে বাচ্চার অবস্থা খারাপ হলে সে অন্য হাসপাতালে রেফার করে দেয় আমরা ওনাকে কিছু বললে উনি বলে সমস্যা নাই রোগী বাঁচবে। অন্য হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করার পর বাচ্চাটি ওই দিনই মারা যায় এবং আমরা দেখতে পাই সম্পার পেটে গজ ও সুই আছে। পরবর্তীতে কুহু ম্যাডামের কাছে এই বিষয়গুলো নিয়ে গেলে তিনি আমাদের কোনো পাত্তা না দিয়ে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন এবং বলেন, তোমরা আমাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করার জন্য এসব কথা বলছ।’
সম্পার শাশুড়ি বলেন, ‘আমার ছেলের সয়-সম্পত্তি নাই, সিএনজি চালিয়ে খায়। ২ শতাংশ জায়গা বিক্রি করে বৌমার চিকিৎসা করাচ্ছে। আমার ছেলে একদম সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। আমি এই দুই ছোট ছোট নাতি নিয়ে যে কী করব তা বুঝতে পারছি না। আমি এই ডাক্তারের সুষ্ঠু বিচার চাই।’
সাংবাদিকরা এ বিষয়ে জানতে চাইলে সম্পার সিজারিয়ান অপারেশন করা ডা. কুহু মুৎসুদ্দি বলেন, ‘এই রোগীটা অপারেশন করার তিনদিন পর আমি সুস্থ অবস্থায় ছেড়ে দেই। পরে তিনি মির্জাপুর ও শেখ ফজিলাতুন্নেছায় চিকিৎসা নেয়। আমার কাছে যতটুকু ছিল সে পর্যন্ত সুস্থ ছিল এখন তারা কোথা থেকে গজ এনে রেখেছে সেটা আমি জানি না। আমি যতগুলো রিপোর্ট দেখেছি সবগুলো নরমাল ছিল।’
কালিয়াকৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. লুৎফর রহমান আজাদ জানান, ‘এই বিষয়টিতে তদন্ত বা বিচার করার এখতিয়ার আমার নেই। এটা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বরাবর দরখাস্ত করতে হবে। এ বিষয়ে বিএমডিসি দেখবে।’
কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ বলেন, ভুল চিকিৎসার বিষয়ে একজন ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি। এর তদন্তের দায়ভার উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে দেওয়া হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে আমরা সুষ্ঠু বিচারের আওতায় আনব। পাশাপাশি ভুক্তভোগী পরিবার যদি আমাদের নিকট আবেদন করে তাহলে আমরা আর্থিক সহযোগিতা করার চেষ্টা করব।
মন্তব্য করুন