একাত্তরে সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন নিয়তি রানী। ক্যাম্পে আটকে ছিলেন ২০ থেকে ২৫ দিন। জেলা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ একাধিক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের প্রত্যয়নে দুইবার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি কর্তৃক সর্বসম্মতক্রমে ‘ক’ তালিকায় স্থান পান তিনি। এর পরও গেজেট তালিকায় নাম লিপিবদ্ধ হয়নি ৭১ বছর বয়সী ত্রিশাল উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের নিয়তি রানীর।
স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও মেলেনি বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি। অবশেষে স্বীকৃতি পেতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লিখেছেন নিয়তি রানী।
বৃহস্পতিবার (২৭ জুলাই) দুপুরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জুয়েল আহমেদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করে পাঠানো হয় ওই চিঠি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হাতে চিঠি হস্তান্তরের সময় উপস্থিত ছিলেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মাহবুবুর রহমান, সাবেক উপজেলা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হেকিম, সাবেক ডেপুটি কমান্ডার এ কে এম ফজলুল হক আবুল, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ, নুরুল ইসলাম, আব্দুল হাকিম, শাহজাহান কবির, আইউব আলী প্রমুখ।
১৯৭১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের সাউথকান্দা গ্রাম থেকে রাশ বিহারী মণ্ডলের ১৮ বছর বয়সী মেয়ে নিয়তি রানীকে ধরে নিয়ে যায় রাজাকাররা। যেখানে সম্ভ্রম হারান তিনি। ২০ থেকে ২৫ দিন তাকে ক্যাম্পে আটকে রাখার পর মেজর আফসার বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালিয়ে সেখান থেকে উদ্ধার করেন নিয়তি রানীকে। দীর্ঘসময় চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে ওঠেন ওই নারী। দেশ স্বাধীনের পর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা নিয়তি রানীকে বীরাঙ্গনা তালিকায় অন্তর্ভুক্তির পরামর্শ দিলেও জীবনের কলঙ্কিত ওই অধ্যায়টি ধামাচাপা রাখতে তাতে সাড়া দেয়নি তার পরিবার।
অতঃপর, একদিন নিয়তি রানীর বাবা রাশ বিহারী মণ্ডল জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বৃপাচাষী গ্রামের পল্লি চিকিৎসক ব্রজেন্দ্র চন্দ্র নমদাসের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে দেন। জেনে-শুনেই সব কিছু স্বাভাবিকভাবে নেন পল্লি চিকিৎসক ব্রজেন্দ্র। সামান্য আয়ে কোনো রকমে সংসার চললেও তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় চরম অভাব-অনটন দেখা দেয় তাদের ঘরে। এরপর নিরুপায় হয়ে সরকারি সুবিধা পেতে ২০১২ ও ২০১৪ সালে অনলাইনে আবেদন করেন তিনি। এতে ২০১৭ সালে ত্রিশাল উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি কর্তৃক সর্বসম্মতক্রমে ‘ক’ তালিকাভুক্ত হয়ে প্রথমবার বীরাঙ্গনা হিসেবে স্বীকৃতি পান নিয়তি রানী।
এ বছর জামুকা কর্তৃক অনলাইনে প্রকাশিত ৫৮ জনের তালিকার ৩২ নম্বরে ছিলেন তিনি (ডিজি নং- ১২১৬৮০৯)। ওই বছরের (১৬ ডিসেম্বর) মহান বিজয় দিবসে বীরাঙ্গনা হিসেবে নিয়তি রানীকে সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু জাফর রিপন। ২০২১ সালেও ফের মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে সর্বসম্মতক্রমে দ্বিতীয়বারের মতো ‘ক’ তালিকাভুক্ত হন তিনি। ১৩ মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষীর প্রত্যয়ন, ১০ জন মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যয়ন ছাড়াও স্থানীয় ১০ জন গণ্যমান্য ব্যক্তির প্রত্যয়নেও বীরাঙ্গনা গেজেট তালিকায় নিয়তি রানীর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। স্বীকৃতির আশায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরের দরজায় কড়া নাড়লেও মেলেনি স্বীকৃতি।
নিয়তি রানীর স্বামী ব্রজেন্দ্র চন্দ্র নমদাস পরলোক গমন করেছেন ২০১৬ সালে। নিয়তি রানী নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। অর্থাভাবে সুচিকিৎসাও করাতে পারছেন না তিনি। মায়ের ওষুধ আর দুবেলা খাবারের জোগান দিতে নিয়তি রানীর মেয়ে অর্চনা রানী সরকার স্থানীয় মিশু বিদ্যানিকেতন ও শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ান। লেখাপড়ার ফাঁকে মায়ের চিকিৎসার জন্য আকিজ বিড়ির সেলসম্যানের কাজ করেন তাদের একমাত্র ছেলে বুদন চন্দ্র দাস।
নিয়তি রানীর ছোট মেয়ে অর্চনা রানী সরকার কালবেলাকে বলেন, আমার মা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। অর্থাভাবে মায়ের সুচিকিৎসা করাতে পারছি না।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুল হেকিম কালবেলাকে বলেন, নিয়তি রানী ২০১৭ ও ২০২১ সালের যাচাই-বাছাইয়ে ‘ক’ তালিকাভুক্ত হয়ে বীরাঙ্গনা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও গেজেট তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত না হওয়াটা দুঃখজনক।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জুয়েল আহমেদ কালবেলাকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী বরাবর নিয়তি রানীর দেওয়া চিঠি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।
মন্তব্য করুন