চট্টগ্রামে দফায় দফায় চলছে কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সংঘর্ষ। সবশেষ বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) দুপুর আড়াইটা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। ছোড়া হয় রাবার বুলেটও। টানা দেড় ঘণ্টার এই সংঘর্ষ বিকেল ৪টা পর্যন্তও থামেনি।
এদিকে সংঘর্ষে গুরুতর আহত হয়েছেন দৈনিক কালবেলার চট্টগ্রাম ব্যুরো চিফ সাইদুল ইসলাম, দীপ্ত টিভির চট্টগ্রাম ব্যুরো চিফ, দৈনিক বণিক বার্তার চট্টগ্রামের ডেপুটি ব্যুরো চিফ সুজিত সাহা, দ্যা ডেইলি স্টার পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার মোহাম্মদ সুমন, চাঁদগাও থানার ওসি জাহিদুল কবিরসহ অন্তত ৩০ জন আন্দোলনকারী। এ ছাড়া আহত হয়েছেন চান্দগাঁও থানার অন্তত ৫ পুলিশ সদস্যও। তাদের কাউকে কাউকে গুরুতর অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আবার কেউ কেউ প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন পাইভেট হাসপাতাল ও স্থানীয় ফার্মেসিতে।
বেলা সাড়ে ৩টার দিকে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন বলেন, গুলিবিদ্ধ দুজনসহ আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৫ জন। তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থাই গুরুতর।
এদিকে সবশেষ পাওয়া খবরে নগরের জিইসি মোড় এলাকায় আন্দোলনকারী এক শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে আহত করার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। অমি নামে ওই শিক্ষার্থীকে দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। আহত অবস্থায় যারা চমেক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তারা হলেন— আরেফিন শুভ, মোহাম্মদ মোরশেদ, সাইদ, শুভ, হিমাদ্রী, মোহাম্মদ মাহিন, মিনহাজুর রহমান, ইসমাইল হোসেন, মোহাম্মদ ইলিয়াছ, মোহাম্মদ বোরহান উদ্দিন, মোহাম্মদ মামুন, আদনান শরীফ, রাকিব শাহরিয়ার এবং হোসেন সোহরাওয়ার্দী। তাদের মধ্যে হোসেন সোহরাওয়ার্দী ব্যবসায়ী, মোরশেদ রিকশাচালক, হিমাদ্রী ও মোহাম্মদ ইলিয়াছ পথচারী, আদনান শরীফ ডেলিভারি ম্যান বলে জানা গেছে। বাকিরা সবাই শিক্ষার্থী।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে সকাল ১০টায় নগরের নগরীর শাহ আমানত সেতু (নতুন ব্রিজ) এলাকা থেকে কমপ্লিট শাটডাউন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। মূলত সেখান থেকেই শুরু হয় সংঘর্ষের সূত্রপাত। সকাল ১১টার দিকে পুলিশ আন্দোলনকারীদের সরে যাওয়ার অনুরোধ জানায়। এরপরও তারা না সরলে পরে পুলিশ তাদের ওপর চড়াও হয়। এ সময় শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে টিয়ার শেল ছোড়ে পুলিশ। জবাবে শিক্ষার্থীরাও ইট ছুড়ে মারেন। এ সময় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ভাঙচুর করা হয় ঈগল পরিবহনের একটি গাড়ি। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা পুলিশের দিকে ঢিল ছুড়তে শুরু করলে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে জবাব দেয়। এতে আহত হন অন্তত ৫০ জন কোটা বিরোধী আন্দোলন করা শিক্ষার্থী।
দুপুর সাড়ে ১২টার পরপরই শিক্ষার্থীরা বাকলিয়া সরকারি কলেজের সামনে জড়ো হতে থাকেন এবং বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা পুলিশ দেখে চড়াও হন। এ সময় তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়লে পুলিশও রাবার বুলেট এবং টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এসময় তাদের সঙ্গে দেশীয় অস্ত্রসহ যোগ দেয় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরাও। পরে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিলে শিক্ষার্থীরা রাহাত্তারপুল ইসলামিয়া মার্কেট পাশের গলির ভেতরে চলে যায়।
বর্তমানে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে বাকলিয়া এলাকায়। সেখানে রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ইট এবং পাথর। রাস্তায় গাড়ি চলাচল একেবারে নেই বললেই চলে। নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে যারা বের হচ্ছেন তারা পায়ে হেঁটেই যাচ্ছেন গন্তব্যে। এ সময় স্থানীয় বাসিন্দারের রাস্তার পাশের অলিগলিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সংবাদকর্মীরা এসময় ফুটেজ নিতে চাইলেও তাদের ওপর চড়াও হয়ে এবং ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে সরিয়ে দিচ্ছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রাহাত্তারপুল এলাকার বি আলম টাওয়ারের সামনে ছাত্রলীগ ও পুলিশের অবস্থান রয়েছে। সেখানে কোনো আন্দোলনকারীকে দেখা যায়নি। পুলিশের একটি সাজোয়া যানও ঘটনাস্থলে রয়েছে।
দুপুর দেড়টার পর থেকেই বহদ্দারহাট কাঁচাবাজার এবং ট্রাফিক পুলিশবক্স সংলগ্ন রাস্তায় একে একে জড়ো হতে থাকেন আন্দোলকারী শিক্ষার্থীরা। সেখানে আগে থেকে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অবস্থান থাকলেও শিক্ষার্থীরা জড়ো হওয়ার খবরে সেখানে আরো অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়। শিক্ষার্থীদের আশপাশেই অবস্থান নিয়েছেন তারা। শিক্ষার্থীরা ‘কোটা না মেধা’, ‘ছাত্রলীগের গদিতে, আগুন জ্বালো একসাথে’ এবং পুলিশকে উদ্দেশ করে ‘ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান দেন। দুপুর ১টা ৫০ মিনিট নাগাদ হঠাৎ করেই স্থানীয় ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীর ওপর হামলা চালায়।
প্রথমে একদল নেতাকর্মী আসেন বহদ্দারহাটের মেয়র গলি থেকে। পরে আরেক দল আসে চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার সড়ক হয়ে। এ সময় তাদের হাতে কিরিচ, রামদাসহ দেশীয় অস্ত্র দেখা গেছে। পরে শিক্ষার্থীরাও পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের উপর ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করে পুলিশ।
কোটাবিরোধী আন্দোলনের চট্টগ্রামের সমন্বয়ক আবুল ফয়েজ মামুন কালবেলাকে বলেন, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অতর্কিত হামলা করেছে। আমাদের এক ভাই গুলিবিদ্ধ হয়েছে। পুলিশ আমাদের সামনেই ছিল। অথচ তারা আমাদের প্রটেক্ট করেনি। অধিকার আদায়ের দাবি নিয়ে রাজপথে নেমে আমাদের এভাবেই কি মার খেতে হবে?
নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের ভাষ্য, তাদের আক্রমণাত্মক ভঙ্গি কোনো সাধারণ শিক্ষার্থীর হতে পারে না। আপনারা (সাংবাদিক), আমরা এবং জনগণ দেখেছে এখানে তারা অসৎ উদ্দেশ্যে ঢাকা-কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ করার জন্য এবং নাশকতা সৃষ্টির জন্য সমবেত হয়েছিল। পুলিশ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অতিরিক্তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন