ঢাকার সাভারে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠছে অবৈধ অয়েল রিফাইনিং কারখানা। এসব কারখানার নির্গত ক্ষতিকর অয়েল ড্রেনের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে পাড়া-মহল্লায়, যা থেকে ঘটছে অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা। এ ছাড়া এসব কারখানার ধোঁয়ায় নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। উপজেলা প্রশাসন বলছে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে যথাযথ ব্যবস্থা।
সাভারের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের জয়নাবাড়ি এলাকায় গড়ে ওঠা অলিউম লুব্রিকেন্টস বিডি কারখানা। যা থেকে নির্গত অয়েল ড্রেনের পানির সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে গত দুই মাসে কারখানার পাশের ব্রিজের নিচে জমা হওয়া ওয়েল থেকে ঘটেছে বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। অগ্নিকাণ্ডের স্থানের মাত্র ৫০ গজের মধ্যেই রয়েছে একটি তৈরি পোশাক কারখানা ও পেট্রোল পাম্প। যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার শঙ্কা স্থানীয়দের।
শুধু অলিউল লুব্রিকেন্টস বিডি কারখানায় নয়, সাভারে আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠেছে আরও বেশ কয়েকটি অয়েল রিফাইনিং কারখানা। এসব কারখানা থেকে নির্গত ওয়েলে একদিকে ঘটছে অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনা, অন্যদিকে কারখানাগুলোর চিমনি দিয়ে বের হওয়া কালো ধোঁয়ায় বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ। যে কারণে শ্বাসকষ্টসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা।
এসব বিষয়ে জানতে আলিয়াম লুব্রিকেন্টস বিডি কারখানায় গেলে সংশ্লিষ্টরা সাংবাদিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। কারখানার বাইরে স্থানীয়দের বক্তব্য নিতে গেলে দলবল নিয়ে গিয়ে বাধা প্রদান করেন আলিয়াম লুব্রিকেন্টস বিডি কারখানার লোকজন।
অয়েল রিফাইনিং প্লান্ট স্থাপন নীতিমালা ২০১৯ এর ৫.৮ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, প্লান্ট স্থাপনের পূর্বে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক অবস্থাগত ছাড়পত্র, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত অগ্নিনির্বাপণ প্ল্যান এবং স্থাপনাসমূহের বিস্ফোরক পরিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত নকশা, জেলা প্রশাসন, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ সরকারের বিধিবদ্ধ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় হতে অনাপত্তিপত্র থাকতে হবে। তবে এসব কোনো কিছুই নেই এসব কারখানার।
আব্দুল কুদ্দুস নামে স্থানীয় এক ভাড়াটিয়া বলেন, এই কারখানা থেকে তেল বের হয়ে নালা দিয়ে ভেসে এসে গ্যাস পাম্পের সঙ্গে যে ব্রিজটি রয়েছে সেখানে এসে জমা হয়। মাঝে মাঝেই এখানে আগুন লাগে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। একাধিকবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। প্রশাসনের সামনেই আবাসিক এলাকায় অরক্ষিতভাবে একটি কারখানা চলছে, এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
শিক্ষার্থী আসিফ আলম বলেন, আমাদের এলাকায় এসব কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি থেকে তেল বের হয়ে বিভিন্ন জায়গায় জমাট বাঁধে এবং সেখানে আগুন ধরে যায়। আমরা খুবই আতঙ্কের মধ্যে থাকি।
স্থানীয় আবেদ আলি নামে ভুক্তভোগী বলেন, এই রাস্তা দিয়ে যারা চলাচল করে তারা কাপড় দিয়ে নাক ঢেকে চলাচল করতে হয়। আমাদের তো আর কিছু করার নেই, কারণ চলাচলের একটাই রাস্তা। বাধ্য হয়ে আমরা এই পথই চলাচলের জন্য নিয়মিত ব্যবহার করছি। কারখানার পাশে বাড়ি হওয়ায় বাধ্য হয়ে এখানেই বসবাস করছি। তবে আমিসহ আমাদের পরিবারের সদস্যরা কয়দিন পরপরই হাঁচি-কাশি ঠান্ডাসহ নানান রোগে শোকে ভুগি। আমি মনে করি এসব কারখানা আবাসিক এলাকায় থাকা কোনোভাবেই ঠিক নয়।
আব্দুল হামিদ নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, কলকারখানার এসব কেমিক্যাল বের হয়ে আমাদের এলাকা একেবারেই বসবাসের অযোগ্য করে ফেলেছে। একদিকে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ অন্যদিকে এই খালে দুর্গন্ধযুক্ত কেমিক্যাল এবং তেল আসায় মশা-মাছির আস্তানায় পরিণত হয়েছে খালটি।এসব ফ্যাক্টরিগুলো আবাসিক এলাকা থেকে যেন দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হয়।
করিম আলি নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, এলাকাটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। একটি আবাসিক এলাকায় কোনোভাবেই এসব কেমিক্যাল অবাধে খাল কিংবা ড্রেনে ছেড়ে দিয়ে পরিবেশ দূষিত করতে পারে না। এগুলো বন্ধে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
স্বপন নামে আর এক ভুক্তভোগী বলেন, একটি মহল্লার ভেতরে এ ধরনের ফ্যাক্টরি থাকা উচিত নয়। এটিকে দ্রুত সরানোর দাবি জানাচ্ছি। মধ্যরাতে ফ্যাক্টরির এসব কেমিক্যাল যখন বেশি পরিমাণে ছাড়া হয় তখন প্রচণ্ড দুর্গন্ধে আমাদের বাচ্চারা মাঝে মাঝেই জেগে গিয়ে কান্নাকাটি করে। একটা বাজে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করছি। দুর্গন্ধের তীব্রতা বাড়লে আমাদের নিঃশ্বাস নিতেই কষ্ট হয়ে যায়। এ ধরনের ফ্যাক্টরিগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে পরিবেশকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারের এগিয়ে আসা উচিত।
আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠা এসব ওয়েল রিফাইনিং কারখানা অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে স্থানীয়দের স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের প্রতি দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাহুল চন্দ কালবেলাকে বলেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না নিয়ে যারা এ ধরনের ব্যবসা করছে, তাদের বিরুদ্ধে আমি শিগগিরই ব্যবস্থা নেব। আমরা দেখেছি ইতোপূর্বে সাভারে বেশকিছু অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এবং বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। নতুন করে যাতে আর কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা না ঘটে সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উপজেলা প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে। আমরা এসব বিষয় নিয়ে উপজেলা পরিষদের নিয়মিত যে বার্ষিক সভা হয়, সেখানেও আলোচনা করেছি। যত বড় প্রভাবশালীই হোক না কেনো সরকারি নিয়মকানুন না মেনে অন্তত সাভার উপজেলায় কাউকে কোনো রকমের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে দেওয়া হবে না।
মন্তব্য করুন