সেই ছোটকালে বাবা নকিম উদ্দিনকে হারিয়েছিলেন রোকেয়া। বৈষম্যের এ সমাজে ছেলেসন্তান নেই বলে স্বামীর ভিটায় ঠাঁই হয়নি মা ময়নার। নিরুপায় হয়ে ছোট ছোট দুটো মেয়ে সন্তানকে নিয়ে ওঠেন বড় বোন বাতাসির বাড়িতে। সন্তানদের লালন করতে ভিক্ষাবৃত্তি ছিল যার পেশা। রোকেয়ার বয়স যখন বারো কি তেরো, ঠিক তখন বিয়ে দিয়ে দেন সুন্দরগঞ্জের পূর্ব সোনারায়ে সামসুল হকের সঙ্গে।
হাফ শতক জমিতে একটি খরের ঘর ছিল সামসুল হকের। পেটের ব্যথায় মাঝেমধ্যে কুঁকড়ে যেত সে। বৈদ্যের কাছে যেতে যেতে সেই হাফ শতক জমিও বিক্রি করে সামসুল। এবার রোকেয়াকে নিয়ে আশ্রয় নেয় হাসপাতাল রোডের দক্ষিণ পাশের গলিতে রোকেয়ার মায়ের কাছে। কিন্তু স্বামীর সুখ আর কপালে সইলো রোকেয়ার। বিয়ের কয়েক বছর যেতে না যেতেই মারা গেল স্বামী সামসুল হক। ফলে মাতৃত্বের স্বাদও আর স্পর্শ করা হয়নি তার।
একে তো নেই বাবা, তার ওপর নেই কোনো আপনজনও। স্বামীর লাশের সঙ্গে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিল রোকেয়া। থাকতেও চেয়েছিল সেখানে। কিন্তু ঠাঁই না পেয়ে চোখের জলে এবার এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়ে সে। ফিরে আবার খালার বাড়িতে থাকা বৃদ্ধা মায়ের কাছে।
এমনিতেই ভালো কাটছিল না মা ময়নার দিনকাল। ভিক্ষের চালে নিজের পেট চালাতেই হিমশিম অবস্থা। অর্ধাহারে জীবন চলত তার। একবেলা খাবার জুটলে তো জুটত না আরেক বেলা। তার ওপর বিধবা মেয়ে কাঁধে এসে পড়ায় চোখে অন্ধকার দেখেন বৃদ্ধা মা ময়না। দুবেলা দুমুঠো খাবার জুটবে কী করে! তাই তো মা ময়নার সঙ্গে নিজেও ভিক্ষা করতে যেত রোকেয়া। বেলা শেষে যা জুটত তা দিয়েই খেয়ে না খেয়ে চলতে থাকে মা-মেয়ের দিনকাল। রোকেয়ার বয়স যখন সত্তরের কাছাকাছি, তখন মাও তাকে ছেড়ে যায় স্রষ্টার ডাকে। মায়ের মৃত্যুতে এবার বড্ড একা হয়ে পড়ে সে। সেই ছোট্ট বেলায় বাবা, বিয়ের পর স্বামী এবং মায়ের মৃত্যুর পর এবার একাকী হয়ে পড়ে রোকেয়া। নেই সন্তানও।
কয়েক যুগ ধরে খালার বাড়িতে থাকায় এখন আর তাকে থাকতে দিতে চাইছে না রোকেয়ার খালাতো বোন। চালার পেছনে ও সামনে নোংরা পানি ও কাদায় মাখামাখি অবস্থা। মাটি কাটতে না পারায় চালার মেঝে এতটাই নোংরা যে, কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে এক মিনিটও টিকে থাকা দায়। ঘরের ভেতরে পড়ে রয়েছে নানা ডাউয়া-ঢোকনা। ভেতরে যে কারো পক্ষে ঢোকাটা বেশ কঠিন। তিল ধারণের ঠাঁই নেই যেন। আলো-বাতাসহীন বদ্ধ জায়গায় ভ্যাপসা গরমের মধ্যেও ছোট্ট চৌকির ওপর কম্বল বিছানো। বৈদ্যুতিক যুগেও আলো নেই কোনো। অন্ধকার ঘোচাতে আছে ছোট্ট একটি টর্চলাইটে ভরসা। পানিও খেতে দেন না খালাতো বোন। অন্যের বাড়ি থেকে পানি এনে তবেই তৃষ্ণা মেটে রোকেয়ার।
একদিন বিকেল বেলা। ভিক্ষা করতে করতে ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির রোকেয়া। খাওয়ার পর দোয়া করে বাড়ির পথ ধরে সে। রাস্তার ধারেই ছিল প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া গৃহহীনদের জন্য লাল, নীল রঙের ঘরের সারি। মসজিদের সামনে বসে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওই লাল, নীল ঘরের দিকে। মচকা খাওয়া কোমরে এবার উঠে দাঁড়ায় রোকেয়া। আর ফিসফিস করে বলতে থাকে, সারাবাড়ি দেখি নাল, নীল কত ঘর! ঈশ! কেউ যদিল একটা ঘর দিলে হয়।
ইউএনও মো. তরিকুল ইসলাম জানান, রোকেয়ার দুর্বিষহ জীবনযাপনের বিষয়টি নিজে পরিদর্শন করে তার আশ্রয়ের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
মন্তব্য করুন