ভবতোষ চৌধুরী নুপুর, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২৪, ০৬:১০ এএম
অনলাইন সংস্করণ

শাপলা ফুলে ঘুরছে কর্মহীনদের ভাগ্যের চাকা

বিক্রির জন্য স্তুপ করে রাখা হয়েছে শাপলা। ছবি : কালবেলা
বিক্রির জন্য স্তুপ করে রাখা হয়েছে শাপলা। ছবি : কালবেলা

মুন্সীগঞ্জের শস্য ভান্ডার নামে খ্যাত আড়িয়াল বিল এখন বর্ষার থৈ-থৈ পানিতে নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যে আবির্ভূত হয়েছে। কৃষি প্রধান এ বিলটিতে শুষ্ক মৌসুমে শাক-সবজি, সরিষা, ভুট্টা ও কুমড়া চাষ হলেও অর্থকরী প্রধান ফসল হিসেবে ধান আবাদ হয় ব্যাপক পরিমাণে।

এর উপর নির্ভর করে বিলবাসী তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তবে বর্ষা মৌসুমে পুরো বিল পানির নিচে তলিয়ে যায়। এমতাবস্থায় কোনো কাজ থাকে না বিলের ওপর নির্ভর করা স্থানীয় কৃষকদের।

প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে সাজানো আড়িয়াল বিল ঋতুভেদে নতুন নতুন বৈচিত্রের প্রকাশ ঘটে। বর্ষাকালে সবুজে ঘেরা বিলের স্বচ্ছ পানিতে পদ্ম ও কচুরি পানার ফুল এবং নানা জাতের পাখির উপস্থিতি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে এক অনন্য মাত্রা যুক্ত করে। আর সেই সৌন্দর্য্যকে অপার রূপে মেলে ধরা বিস্তীর্ণ বিলে জন্মানো শাপলা, বেকার হয়ে পরা নিন্ম আয়ের পরিবারগুলোর মাঝে জীবিকার চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।

এ সময়টাতে বিলে জন্মানো শাপলাই হয়ে উঠে কর্মহীন মানুষদের জীবন-জীবিকার আশার আলো। বর্ষা মৌসুমে আড়িয়াল বিলের শাপলা খুলেছে কর্মহীনদের ভাগ্যের চাকা। দিনের কয়েক ঘন্টায় কুড়ানো শাপলা বিক্রি করেই সংসার চালাচ্ছেন অন্তত পাঁচ শতাধিক পরিবার।

আর এসব পরিবারগুলো দৈনিক শাপলা বিক্রি করে আয় করছে ৫০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা। স্থানীয় বাজার ছাড়াও আড়িয়াল বিলের শাপলা অন্যান্য উৎপাদিত পণ্যের মতো রাজধানী বাজারগুলোতে বিক্রি হয়ে থাকে।

অনেক সময় স্থানীয়রা শাপলা বিক্রেতারা ট্রাক কিংবা পিকআপভ্যানে করে রাজধানীসহ আশেপাশের বিভিন্ন বাজারে গিয়ে বিক্রি করে আসে। আবার ঢাকার বড় বড় অনেক পাইকাররা বিল পারে এসে কিনে নিয়ে যায় আড়িয়াল বিলের শাপলা। ২০ পিস ফুল ও ডিগসহ এক আটি শাপলা ১৪ থেকে ১৬ টাকা দরে কিনে থাকেন পাইকাররা। তবে খুচরা বাজারে এর দাম আরও বেশি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলার গাদিঘাট, আলমপুর, লস্করপুর, মদনখালী ও শ্রীধরপুর গ্রাম সংলগ্ন আঁড়িয়াল বিলে প্রকৃতির দান শাপলা কুড়াতে ব্যস্ত সময় পার করছে স্থানীয়রা। প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই বিলে নেমে পড়েন কর্মহীন কিশোর-তরুণ থেকে শুরু করে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় করে বিলের পানে তাদের ছুটে চলার দৃশ্য চোখে পড়ার মতো।

একেকটি ডিঙ্গি কিংবা নৌকায় ৩/৪ জন থাকেন। দুপুরের মধ্যেই শাপলা ভর্তি নৌকাগুলো পর্যায়ক্রমে চলে আসে বিল পারে। বিকেলের মধ্যেই বিল সংলগ্ন গ্রামের রাস্তার পাশে স্তুপ করে রাখা হয় বিক্রির জন্য। সেখান থেকে পাইকাররা শাপলা কিনে তাদের স্ব-স্ব গন্তব্যে নিয়ে যান।

মো. নাজির হোসেন বলেন, সবজি হিসেবে খাবারের তালিকায় শাপলার জুড়ি নেই। বর্ষা মৌসুমে সবজি হিসেবে শাপলা খুব কম দামে পাওয়া যায়। তা ছাড়া এর পুষ্টিগুণ অনেক। বড়া কিংবা চর্চরীসহ বিভিন্ন মজার খাবার তৈরি করা হয় শাপলা দিয়ে। তাই বর্ষা মৌসুমে অনেকের কাছে প্রিয় সবজি হয়ে থাকে শাপলা। এমতাবস্থায় আড়িয়াল বিলের শাপলারও দিন দিন কদর বাড়ছে। তাই শাপলা কুড়িয়ে বিক্রি করে রোজগারের পথ খুঁজে পেয়েছেন বিলের অসংখ্য পরিবার।

উপজেলার গাদিঘাট গ্রামের বাসিন্দা মো. নুরুজ্জমান বলেন, সাধারণত আমি কৃষি কাজ করি। বর্ষা মৌসুমে হাতে কোনো কাজ না থাকায় বিস্তীর্ণ বিলে শাপলা কুড়িয়ে সংসারের খরচ মেটাই।

তিনি বলেন, সকালে ডিঙ্গী নিয়ে বেরিয়ে শাপলা কুড়াতে আধাবেলা বিলে ঘুরে বেড়াই। প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ আঁটি শাপলা কুড়িয়ে পাই। এক একটি আঁটিতে ২০টি করে শাপলা থাকে। যা পাইকারদের কাছে আঁটি প্রতি ১৪ টাকা করে বিক্রি করি। এতে কোনোদিন ৫০০ টাকা আবার কোনোদিন ৭০০ টাকার শাপলা বিক্রি করতে পারি।

দিনমজুর মো. মিরাজ বলেন, বর্ষায় কোনো কাজ না থাকায় উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন আড়িয়াল বিলের শাপলা। দুপুরের মধ্যে বিল থেকে শাপলা তুলে গ্রামের রাস্তার পাশে এনে স্তুপ করে রাখি। বিকেলে বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা আসেন। সন্ধ্যার মধ্যে বিক্রি শেষ হয়ে যায়। শাপলা কুড়িয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি কিছু সঞ্চয়ও করতে পারি। মোটামুটি ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকার শাপলা বিক্রি করে থাকি প্রতিদিন।

বিলবাসী আলমগীর হোসেন জানান, অনেকেই দেখি একটি নৌকাতে ৩/৪ জন মিলে শাপলা কুড়াতে বের হয়। এরাই বেশি পরিমাণে শাপলা কুড়াতে পারে। এতে তাদের আয়ও হয় বেশি। আঁড়িয়াল বিলের বিভিন্ন গ্রামের অন্তত পাঁচ শতাধিক পরিবার শাপলা কুড়িয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে। এরা প্রতিদিন সর্বনিম্ন ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ওপরে শাপলা বিক্রি করে থাকে।

আলমপুর গ্রামের মো. আয়নাল হক বলেন, স্থানীয়দের কাছ থেকে পাইকারি শাপলা কিনে ঢাকার বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করে থাকি। বর্ষার শুরুতে বিলে পানি কম থাকায় এখন শাপলার পরিমাণও কম। তবে পানি বাড়লে শাপলাও বাড়বে বিলে। এক একটি শাপলার আটি ১৪ টাকা থেকে ১৬ টাকা করে কিনতে হয়।

পাইকারী ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, আড়িয়াল বিলের শুধু গাদিঘাট গ্রাম থেকেই প্রতিদিন চারটি পিকআপ ভর্তি করে শাপলা ঢাকায় নিয়ে বিভিন্ন মার্কেটে পাইকারি বিক্রি করি। এখান থেকে প্রতি আঁটি শাপলা ১৬ টাকা দরে কিনে ঢাকার বিভিন্ন বাজারে এক আঁটি শাপলা ৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়ে থাকি। তবে পানি আরও বৃদ্ধি পেলে শাপলা ও বৃদ্ধি পাবে। সে সময় দামও কমে যাবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত কালবেলাকে বলেন, এ বর্ষা মৌসুমে মুন্সীগঞ্জের দুটি উপজেলা শ্রীনগর ও সিরাজদিখানের বেশকিছু বড় জলাশয় রয়েছে যেখানে প্রাকৃতিকভাবেই শাপলা জন্মে থাকে। যেহেতু এ শাপলা অনেকের খাদ্যতালিকায় থাকে তাই এর বিক্রিও ব্যাপকহারে।

তিনি বলেন, আমাদের কাছে পরিসংখ্যান না থাকলেও এ দুই উপজেলার অনেক মানুষ আছেন যারা এ সময়ে শাপলা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এসব খেটে খাওয়া মানুষের কাছে বর্ষা মৌসুমে শাপলা একটা আর্শীবাদ।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বগুড়ায় ৫ ইউএনওর মোবাইল নম্বর ক্লোন করে চাঁদা দাবি

৩ মিনিটের ঝড়ে লণ্ডভণ্ড ফরিদপুর

ইরান নিয়ে ইসরায়েলের সামনে এখন ‘প্ল্যান বি’

আ.লীগের মিছিলের প্রস্তুতির সময় বিএনপি নেতার ছেলে গ্রেপ্তার

১০০ আসনে নারীদের সরাসরি নির্বাচন চায় এনসিপি

সরিয়ে দেওয়া হলো স্বাস্থ্য উপদেষ্টার এপিএসকেও

রেকর্ড ভেঙে সোনার দামে নতুন ইতিহাস

আরেক দেশকে নিয়ে ‘বিশাল যুদ্ধ মহড়ায়’ যুক্তরাষ্ট্র

বাকেরগঞ্জে কারখানা নদীর বালুমহাল ইজারা বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন

টানা পাঁচ দিন ঝরবে বৃষ্টি    

১০

কালবৈশাখী ঝড়ে লণ্ডভণ্ড মিরসরাই

১১

মেজর সিনহা হত্যা মামলার আপিল শুনানি বুধবার

১২

লেভানডভস্কির চোটে বার্সা শিবিরে দুঃশ্চিন্তা

১৩

ডিসি শাকিলাকে রেলওয়ে পুলিশে বদলি

১৪

ছাত্রদলে পদ পেতে স্ত্রীকে তালাক, ফয়সাল রেজার অব্যাহতি

১৫

কালীগঞ্জে জামায়াতে ইসলামীর প্রস্তুতি সভা

১৬

প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ধর্মগুরু হন পোপ ফ্রান্সিস

১৭

পূর্ব শত্রুতার জেরে কৃষকের পাকা ধান কেটে নিল প্রতিপক্ষ

১৮

তুরস্কের ভয়ংকর ড্রোনের জনক কে এই সেলচুক বায়রাকতার

১৯

হত্যা মামলায় আ.লীগ নেতা বাবা-ছেলে রিমান্ডে

২০
X