শেখ মমিন, রাজবাড়ী প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০২৪, ০৭:৫৭ এএম
অনলাইন সংস্করণ

রাক্ষুসে পদ্মা গিলে খেতে বসেছে শতশত বসতবাড়ি-দোকানপাট

পদ্মা নদী গিলে খেতে বসেছে শতশত বসতবাড়ি-দোকানপাট। ছবি : কালবেলা
পদ্মা নদী গিলে খেতে বসেছে শতশত বসতবাড়ি-দোকানপাট। ছবি : কালবেলা

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলায় নদীভাঙন, প্রতি বছরেরই একটা বড় সমস্যা। নদী ভাঙতে ভাঙতে গোয়ালন্দ উপজেলার মানচিত্র অনেক ছোট হয়ে গেছে। নদীভাঙন তীব্র হওয়ায় পাড়ের বাসিন্দারা প্রায় নিঃস্ব হওয়ার পথে। তবে নেই কোনো কর্তৃপক্ষ ও জনপ্রতিনিধির নজর। প্রতি বছর ভাঙতে ভাঙতে শেষ হওয়ার পথে এ উপজেলা। তবুও হচ্ছে না নদীশাসন বা স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা।

প্রায় এক মাসের অধিক সময় ধরে গোয়ালন্দের দৌলতদিয়ায় তীব্রভাবে নদীর পাড় ভাঙলেও প্রয়োজনীয় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেউ। ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে প্রায় কয়েক হাজার পরিবার, দোকানপাট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে ভাঙনরোধে অতি দ্রুতই কাজ করার আশ্বাস দিয়েছেন গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র।

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়ন দুটি পদ্মার ভাঙনের শিকার প্রতি বছর। আর এটা এ উপজেলার বড় একটা সমস্যা। নদী ভাঙন সমস্যাটা এ উপজেলার দীর্ঘ বছরের সমস্যা।

পদ্মার ভাঙনে বাপ দাদার ভিটে মাটি এবং বাপ দাদার শেষ সম্বলটুকু কবরের চিহ্নটুকুও চলে গেছে নদীগর্ভে। নদী ভাঙনের শিকার এ উপজেলার হাজার হাজার মানুষ। শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। তবুও স্থায়ীভাবে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ।

এটা দীর্ঘ বছরের সমস্যা হলেও জনপ্রতিনিধি বা কর্তৃপক্ষের নেই কোনো বিশেষ নজর। আর কর্তৃপক্ষের নজর না থাকায় প্রতি বছরই নতুন করে ভাঙছে পদ্মার পাড় এবং সব হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন এলাকাবাসী। পদ্মায় যখন পানি আসে এবং যখন নদীর পানি কমে যায় সাধারণত এ দুটি সময়ই ভাঙনের মাত্রা তীব্র হয়। আর এসময়ই নামমাত্র ফেরিঘাট রক্ষার্থে কাজ করে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ।

অথচ শুষ্ক মৌসুমের সময় কাজ হলে ভাঙনরোধে বেশি গুরুত্ব হয়। শুষ্ক মৌসুমে কাজ না করে ভরা মৌসুমের সময় নামমাত্র দেখানো কাজ করে কর্তৃপক্ষ। তখন এ ধরনের কাজ ভাঙন রোধে তেমন কাজেই আসে না।

তবে দেখা গেছে, প্রতি বছর নদীর পাড় ভাঙলে জরুরিভাবে জিও ব্যাগ ফেলানো হয় এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু এ বছর পদ্মার ভাঙন তীব্র হলেও এখন পর্যন্ত কোনো জরুরিভাবে পাড় রক্ষায় কোনো ধরনের কোনো কাজ করেননি কর্তৃপক্ষ।

এদিকে দীর্ঘ এক মাসের অধিক সময় ধরে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ৬নং ফেরিঘাট ও ৭নং ফেরিঘাটের আশেপাশে ভাঙছে। দৌলতদিয়া সাত্তার মেম্বার পাড়া এলাকার পদ্মা পাড়ের ভাঙন আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করছে হাজার হাজার পরিবার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শতশত দোকানপাট রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে। এ বছর পদ্মার পাড় রক্ষায় প্রয়োজনীয় কোনো জরুরি ব্যবস্থা না নেওয়ায় পাড়ের বাসিন্দাররা পড়েছেন চরম বিপদে। বসতবাড়ি নদীতে চলে গেলে তাদের মাথা গুজার কোনো ঠাঁই নেই। ছেলে সন্তান নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন পাড়ের মানুষ। তাদের আর্তনাদ যেন কেউই দেখছেন না এবং কারও নজরেই যেন পড়ছে না। বর্তমানে পদ্মা নদীতে ভরা মৌসুম।

প্রতিদিনই বাড়ছে পানি। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিধে বাড়ছে রাক্ষুসে পদ্মার। সঙ্গে ভাঙছে পাড়। ভাঙনের মাত্রা অতি তীব্র হওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন পদ্মাপাড়ের হাজারো মানুষ। আর তীব্র ভাঙনের মধ্যেও জরুরিভাবে ভাঙনরোধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় হতাশার মধ্যে থেকেও স্থানীয় এলাকাবাসী ব্যক্তি উদ্যোগে বাঁশ, বস্তা ও মাটি দিয়ে ভাঙন রোধের চেষ্টা করেছেন। দৌলতদিয়া ৬নং ফেরিঘাটের বারেক মৃর্ধার দোকানের সামনে সরেজমিনে এমন চিত্র দেখা যায়।

জানা গেছে, পাড়ের স্থানীয় এলাকাবাসী একত্রিত হয়ে প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ করে স্ব স্ব শ্রমের মাধ্যমে তারা ভাঙন রোধের জন্য কাজ করেছেন। তবে দ্রুতই জিও ব্যাগ ও জরুরিভাবে প্রয়োজনীয় কাজ করার দাবি জানিয়েছেন হাজারো মানুষ। আর প্রতি সপ্তাহে আরিচা থেকে ঘাটের ভাঙন পরিদর্শনে আসেন বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ।

তবে নেই কোনো বিশেষ নজর। নেই ঘাটের ভাঙন রোধে জরুরি কোনো ব্যবস্থা। আর ভাঙন রোধে জরুরিভাবে জিও ব্যাগ বা জরুরি কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় চরম হতাশায় পদ্মা পাড়ের হাজার হাজার মানুষ। আর দ্রুতই জরুরিভাবে ভাঙনরোধে কাজ করা না হলে রাক্ষুসে পদ্মা গিলে খাবে শতশত বসতবাড়ি দোকানপাট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

বারেক মৃর্ধা নামের পদ্মা পাড়ের স্থায়ী দোকানদার কালবেলাকে বলেন, পদ্মা নদীর পাড়ে দীর্ঘ বছর ধরে দোকান করে আসছি। দোকান করে জীবিকা নির্বাহ করি আমি। যেভাবে নদী ভাঙছে আর কয়েকটা চাপ পড়লেই আমার দোকানটা নদী গর্ভে চলে যাবে। একেবারে জীবনের মতো নিঃস্ব হয়ে যাবো। তখন সংসার চালাবো কীভাবে, এই ভেবে আমার ঘুম আসে না রাতে। খুব ভয়ে আছি, কখন জানি আমার দোকানটা নদীতে চলে যায়। তবে প্রায় দেড় মাস ধরে নদী ভাঙছে এটা কারও নজরে পড়ছে না। তাই আমি নিজ উদ্যোগে ৯ হাজার টাকা ব্যয় করে বস্তায় মাটি ভরে নদীর ভাঙনরোধে সামান্য চেষ্টা করেছি।

আরিফ শেখ নামের নদীপাড়ের এক বাসিন্দা কালবেলাকে বলেন, কোথায় যাবো, আমাদের তো যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নাই। নদীতে আমার বসতঘর চলে যাওয়ার মতো অবস্থা। কিন্তু নদী রক্ষায় কোনো কাজ হচ্ছে না। আমরা হতাশার মধ্যে আছি। ছেলে সন্তান নিয়ে রাতে ঘুমাতে পারি না। আমরা খুবই বিপদে আছি। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া এটা দেখার মতো আর কোনো মানুষ নাই।

বিল্লাল হোসেন কালবেলাকে বলেন, নির্বাচনের সময় জনপ্রতিনিধিরা আসেন, তারা বলেন নদী শাসন হবে। খুব তাড়াতাড়ি নদী শাসনের কাজ করা হবে। নদী শাসনের কাজ এসে গেছে আর কয়েক দিন বাকি। তবে নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে তাদের আর দেখা যায় না। যেভাবে নদী ভাঙছে এখানে জনপ্রতিনিধিদের মুখ্য কোনো ভূমিকা নেই। নদী ভাঙছে, কিন্তু তাদের কিছু যায় আসে না। তাদের তরফ থেকে আমাদের কোনো খবর নেওয়া হয় না। আমরা খুবই অসহায়ত্বের মধ্যে আছি।

মামুন মোল্লা কালবেলাকে বলেন, আসলে কর্তৃপক্ষের এখানে কোনো নজরই নাই। কারণ বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ এখানে প্রায় প্রতিদিনই আসে, তবে এখানে কাজ করে না। বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ শুধু তাদের পল্টনগুলো দেখতে আসে। পল্টনগুলো দেখে চলে যায়। আমাদের মতো হাজার হাজার মানুষের বাড়িঘর নদীতে ভেঙে গেলে তাদের কিছুই যায় আসে না। বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষের বিশেষ কোনো নজরই এখানে নাই। তারা শুধু নামমাত্র দেখানোর কাজ করে। তাও এ বছর এখনো কোনো কাজই তারা করে নাই।

এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ আরিচা অঞ্চলের সহকারী প্রকৌশলী নেপাল চন্দ্র দেবনাথ কালবেলাকে বলেন, দৌলতদিয়ায় বিআইডব্লিউটিএ এর ৭টি ফেরিঘাট আছে। বিআইডব্লিউটিএ থেকে আমরা শুধু ঘাট রক্ষার কাজ করে থাকি। ঘাট যদি ঝুঁকির মধ্যে থাকে তাহলে আমরা ঘাট রক্ষা করার জন্য শুধু কাজ করবো। ফেরিঘাট রক্ষায় আমাদের কোনো কাজ করার ইখতিয়ার নাই। ঘাটের স্বার্থে যদি কাজ করার প্রয়োজন বলে মনে হয় তাহলে আমরা কাজ করব। ঘাট রক্ষার্থে যদি কিছু করা যায় এ চিন্তাগুলোই আমাদের আছে।

গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র কালবেলাকে বলেন, আসলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তারা এটা করছে, আমরা সাধুবাদ জানাই। কিন্তু আমরা তো আমাদের তরফ থেকে চেষ্টা করছি। এ বিষয়টি ঊর্ধ্বতন মহলে জানানো হয়েছে। তারা আশ্বাস দিয়েছেন দ্রুত একটা প্রকল্প দিবেন।

তিনি আরও বলেন, পাড়ের বাসিন্দারা নিজস্ব উদ্যোগে কাজ করছে, এখানে চাইলেই উপজেলা প্রশাসন কাজ করতে পারে না। এখানে নদী নিয়ে দুইটা কর্তৃপক্ষ পানি উন্নয়ন বোর্ড আছে এবং বিআইডব্লিউটিএ আছে। এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষকে আমরা লিখিতভাবে জানিয়েছি। আর পাড়ের বাসিন্দারা যারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাজ করছেন, তাদের যদি কোনো সাহায্য সহযোগিতা লাগে আমরা করব।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সুস্থ থাকতে ভাত নাকি রুটি, কী বলছেন চিকিৎসক

লিটনের শরীরে ৫ শতাধিক বুলেট

সপ্তম রাউন্ডে জমে উঠেছে প্রিমিয়ার লিগের লড়াই

পাচারের টাকায় আমিরাতে মিনি সিটি নিয়ে আসিফের স্ট্যাটাস

শেরপুরে ভয়াবহ বন্যায় লাখো মানুষ পানিবন্দি, মৃত্যু ৫

তিন বিভাগে ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস গবেষকের

সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার আক্ষেপ জ্যোতির

১৩ জেলায় দুপুরের মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা

ভারতীয় দলে আচমকা পরিবর্তন

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ২৮ শিক্ষার্থী বহিষ্কার

১০

৮ বিভাগেই বৃষ্টির পূর্বাভাস

১১

৬ অক্টোবর : নামাজের সময়সূচি

১২

কুমির ভেবে ঘড়িয়াল বেঁধে রাখলেন স্থানীয়রা

১৩

ইতিহাসের এই দিনে আলোচিত যত ঘটনা

১৪

টাঙ্গাইলে কুকুরের কামড়ে শিশুসহ আহত ২১

১৫

রোববার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

১৬

বন্যা মোকাবিলা ও পুনর্বাসনে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের বৈঠক

১৭

খুবিতে তৃতীয় নৈয়ায়িক ন্যাশনালসে চ্যাম্পিয়ন চবি

১৮

গণহত্যায় জড়িতদের বিচার দাবি সমমনা জোটের

১৯

সিলেট কারাগারেই চিকিৎসা চলছে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী মান্নানের

২০
X