শেখ মমিন, রাজবাড়ী প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০২৪, ১০:৪২ এএম
অনলাইন সংস্করণ

প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় পদ্মায় জেলেদের থেকে চাঁদা উত্তোলন!

পদ্মা নদীতে সারি সারি নৌকা। ছবি : কালবেলা
পদ্মা নদীতে সারি সারি নৌকা। ছবি : কালবেলা

প্রতি বছরই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বর্ষা মৌসুমে পদ্মা নদীতে মাছ ধরতে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ায় আসেন জেলেরা। আর এ সুযোগে জেলেদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে চাঁদা। প্রশাসনকে বৃদ্ধা আঙুল দেখিয়ে প্রতিনিয়ত জেলেদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে জেলার দৌলতদিয়া ৭নং ফেরিঘাটের সংঘবদ্ধ যুবক। আর দৌলতদিয়ার স্থায়ী জেলে ছাড়া বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অর্থাৎ বাইরে থেকে আসা জেলেদের নৌকাপ্রতি দিতে হচ্ছে হাজার হাজার টাকা। তবে অভিযোগ প্রমাণ পেলে দ্রুতই ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র।

রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া পদ্মা নদীতে ভরা মৌসুমে বিভিন্ন জায়গা থেকে জেলেরা আসে মাছ ধরতে। কিন্তু এখন নদীতে ভরা মৌসুম থাকলেও পর্যাপ্ত মাছ পাচ্ছেন না জেলেরা। বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে বা সুদে করে নৌকা (ট্রলার) মেরামত করে এবং মাছ মারার জন্য জাল দড়িসহ বিভিন্ন উপকরণ প্রস্তুত করেছে। একদিকে যেমন ঋণের বোঝা অন্যদিকে পর্যাপ্ত মাছ না পাওয়া জেলেদের মধ্যে নেমে এসেছে বিরাট হতাশা। আর বাইরের জেলা থেকে পদ্মা নদীতে মাছ ধরতে আসা জেলেরা পড়েছে বড় বিপদে। প্রতি নৌকায় (ট্রলার) কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ জন জেলে থাকে। তাদের প্রত্যেকের পরিবার আছে। পরিবারের খরচ মেটাতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। এখন নদীতে ভরা মৌসুম থাকলেও তাদের জালে মিলছে না পর্যাপ্ত মাছ। তাই জেলেদের এখনকার দিনগুলো কাটছে হতাশা ও দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে।

আর এদিকে দৌলতদিয়া দেবগ্রাম মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে অন্য জেলা থেকে আসা জেলের নৌকা (ট্রলার) প্রতি টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়াও প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় সিরিয়ালের নামেও চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ করেছেন জেলেরা। অন্য জেলা থেকে আসা জেলেদের দৌলতদিয়া দেবগ্রাম মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে সংগঠনকে দিতে হচ্ছে নৌকা (ট্রলার) প্রতি প্রায় ৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর সিরিয়ালের নামে সংঘবদ্ধ কয়েকজন যুবক হাতিয়ে নিচ্ছে জেলেদের নৌকা (ট্রলার) প্রতি ১০০ টাকা করে। জেলের জালে মাছ পড়ুক আর না পড়ুক পদ্মা নদীতে মাছ ধরতে নামলেই টাকা দিতে হবে সংঘবদ্ধ যুবকদের। সিরিয়ালের জন্য ১০০ টাকা করে না দিলে জেলের নৌকা (ট্রলার) পদ্মা নদীতে নামতে দেওয়া হয় না। আর তখনি ঘটে বিপত্তি। জেলেরা বাধ্য হয়ে স্থানীয় ও অন্য জেলা থেকে আসা প্রত্যেক জেলেরাই বাধ্য হয়ে ১০০ টাকা দিচ্ছেন। এটা রাত ও দিন ২৪ ঘণ্টাই জেলেদের এক প্রকার জিম্মি করে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। সিরিয়ালের টাকা না দিলে জেলেদের মারধরের ঘটনাও ঘটেছে অনেক।

অন্য জেলা থেকে মাছ ধরতে আসা জেলেরা জানায়, এককালীন হিসেবে টাকা দিতে হয় পদ্মা নদীতে মাছ ধরার জন্য দৌলতদিয়া মৎস্যজীবী সমিতিকে। ভয়ে জেলেরা একথাগুলো বলতেও পারছেন না। সত্য কথাগুলো বললে তাদের ওপর নেমে আসবে অমানুষিক নির্যাতন এবং নদীতে নামতে দেয়া হবে না বলেও এমন অভিযোগ করেছেন একাধিক জেলে।

সরেজমিনে দেখা যায়, দৌলতদিয়া ৭নং ফেরিঘাটের সাত্তার মেম্বার পাড়া এলাকার পদ্মাপাড়ে। আর এ বিষয়টি গোয়ালন্দ উপজেলা প্রশাসন, দৌলতদিয়া নৌপুলিশ ফাঁড়ি ও জনপ্রতিনিধি কারও যেন নজরে পড়ছে না।

জানা গেছে, পদ্মা নদীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়ায় জেলেদের মোট নৌকা (ট্রলার) রয়েছে প্রায় ৫৫টির মতো। তিনটি গ্রুপ করে পদ্মায় মাছ ধরতে নামে জেলেরা। এক গ্রুপে ১৮ জন, আরেক গ্রুপে ১৮ জন এবং অন্য আরেকটি গ্রুপে ১৯ জন। এখানে স্থানীয় নৌকা রয়েছে প্রায় ২০টির মতো আর অন্য জেলা থেকে আসা জেলেদের নৌকা রয়েছে প্রায় ৩৫টির মতো এবং ৩টি স্পটে নৌকা (ট্রলার) প্রতি ১০০ টাকা করে হাতিয়ে নিচ্ছে জেলেদের কাছ থেকে।

জেলেরা জানায়, স্থানীয় দৌলতদিয়া ৭নং ফেরিঘাটের বাসিন্দা, হেলাল মন্ডল, আসলাম, বারেক মন্ডল, আয়ুব আলী, শামীম মন্ডল ও উজ্জল হোসেনসহ কয়েকজন যুবক সিরিয়ালের নামে নৌকা প্রতি টাকা উঠাচ্ছে। এবং এরা তিনটি গ্রুপ করে পদ্মাপাড়ের তিন স্পটে টাকা উত্তোলন করছে।

স্পট তিনটি হলো: দৌলতদিয়া ৭নং ফেরিঘাটের পাশে, কলাবাগান এবং কুশাহাটা এলাকায় সংঘবদ্ধ যুবকরা রাতে ও দিনে ১০০ টাকা করে নৌকা প্রতি চাঁদা তুলছে। যতবার পদ্মা নদীতে জেলেদের নৌকা নামবে মাছ ধরতে ঠিক ততবারই টাকা দিতে হয়। আর অন্য জেলা থেকে আসা জেলেদের কাছ থেকে সুকৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে এককালীন বড় একটি অর্থ দৌলতদিয়া দেবগ্রাম মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে।

সিরাজগঞ্জ থেকে আসা আযুব আলী শেখ নামের এক জেলে কালবেলাকে বলেন, আমরা খেও দিলেই ১০০ করে টাকা দেই। নদীতে নামলেই টাকা দিতে হবে। টাকা না দিলে আমরা সিরিয়াল পাব না, খেও দিতে পারব না।

মানিকগঞ্জ থেকে আসা নিত্ত হলদার নামের জেলে কালবেলাকে বলেন, আমরা এক নৌকায় ১৪ জন আছি। নদীতে পর্যাপ্ত মাছ নাই আমাদের সংসার চলতেছে না। আমরা এখানে কয়েকটা নৌকা এসেছি মাছ ধরতে। নৌকা প্রতি এককালীন অনেক টাকাই দেয়া লাগছে। ১৫,০০০ এবং ২০,০০০ এ রকম দেয়া লাগছে। মাছ না পাইলেও টাকা দিতে হবে তাদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজবাড়ী সদরের এক জেলে কালবেলাকে বলেন, আমরা এখানে মাছ ধরতে ৭টা নৌকা এসেছি। নৌকা প্রতি ৫,০০০ টাকা দিয়ে জাল বাচ্ছি। সাতটা নৌকা থেকে আমরা মোট ৩৫,০০০ টাকা দিয়েছি।

ভুক্তভোগী জেলেরা কালবেলাকে জানায়, বর্তমানে ভরা মৌসুমেও মাছ পাচ্ছে না তারা। আর জালে মাছ ধরা না পড়লেও চাঁদার টাকা দিতে হয় নদীতে নামার আগেই। দায় দেনা করে পদ্মায় এসেছে জেলেরা। যেখানে পরিবার-পরিজনকে নিয়মিতভাবে খরচ চালাতে পারছেন না। সেখানে চাঁদা দিতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত নদীতে নামার আগেই। এ থেকে মুক্তি চায় তারা।

দৌলতদিয়া দেবগ্রাম মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক, অসেল বেপারী কালবেলাকে বলেন, এখানে জেলেদের যাতে কোনো ঝামেলা না হয় তার জন্যই এখানে ৬ জন যুবক, হেলাল মন্ডল, আসলাম, বারেক মন্ডল, আয়ুব আলী, শামীম মন্ডল ও উজ্জল হোসেন জেলেদের নৌকা প্রতি ১০০ টাকা করে নেয়। এ টাকাগুলো তারাই নেয়। কারণ তারা পদ্মা নদীতে নামার সিরিয়াল দেয়।

তিনি আরও বলেন, আমার জানামতে এগুলো তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। তবে বাইরের জেলে এবং এখানকার জেলেদের সঙ্গে বসার পরিকল্পনা নিচ্ছি আমাদের মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সঞ্চয়ের কালেকশন করার জন্য।

দৌলতদিয়া দেবগ্রাম মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি, ইসহাক সরদার কালবেলাকে বলেন, অন্য জেলা থেকে আসা জেলেদের কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়া হয় না। যদি কোনো জেলে এমন অভিযোগ দেয়, তাহলে তাকে আমাদের সামনে নিয়ে আসুন আমাদের সামনে এসে বলুক। আমরা কোনো জেলের কাছ থেকে কোনো টাকা নেই নাই। এমন অভিযোগ মিথ্যা।

স্থানীয় ইউপি সদস্য, কাশেম খান কালবেলাকে বলেন, অন্য জেলা থেকে আসা জেলেদের নৌকা থেকে মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে কেউ টাকা নিয়েছে কিনা আমার জানা নেই। তবে জেলেদের নৌকা সিরিয়ালের নামে ১০০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। কখনো এ বিষয়টি আমাদেরকে মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির কেউ জানায়নি।

অতিরিক্ত দায়িত্বরত গোয়ালন্দ উপজেলা ও সদর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. মোস্তফা আল রাজীব কালবেলাকে জানান, বিষয়টা আপনার কাছ থেকে আমি প্রথম শুনলাম। আমার একটু খোঁজখবর নিতে হবে আসলে বিষয়টা কী। আর এ রকম তো নেওয়ার কোনো সুযোগ নাই। এ রকম যদি কেউ নিয়ে থাকে তাহলে দেখি ব্যবস্থা নেওয়া যায় কি না। আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিষয়টা বলব।

গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র কালবেলাকে জানান, এগুলো তো আমার জানা নাই। এটা কী ধরনের চাঁদাবাজি। এ রকম তো নেওয়ার কোনো সুযোগ নাই। নদী তো ওপেন। নদীতে মাছ ধরার জন্য কাউকে টাকা দিতে হবে, এ রকম তো কোনো নিয়ম নাই। ঘটনা সত্য হলে অতি দ্রুতই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।

নৌপুলিশ ফরিদপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান কালবেলাকে জানান, এ রকম তো ঢালাওভাবে কোনো নিউজ আমাদের কাছে ওইভাবে নাই। এ বিষয়টা আমার নলেজে নাই। এ সম্পর্কে বিস্তারিত থাকলে আমাকে পাঠান। আমি তদন্ত করে দেখি। তারপর বলব।

তবে তিনি বলেন, ওইখানে জেলেদের নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক কাজ করছে দৌলতদিয়া নৌপুলিশ ফাঁড়ি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িত থাকায় ইউপি চেয়ারম্যান বরখাস্ত

নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ বিভাগে ভর্তির ব্যবহারিক পরীক্ষা স্থগিত

কোচকে পাত্তাই দেন না ব্রাজিলের ফুটবলাররা!

বৃক্ষরোপণের মহোৎসব / ‘এক আঙিনায় তিনটি গাছ, শান্তিতে থাকি বারো মাস’

ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

গাজায় ইসরায়েলি মেজর নিহত

সৌদি আরবে নিহত শ্রমিকের মরদেহ দেশে আনতে চান পরিবার

বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শিরিনের

রাক্ষুসে পদ্মা গিলে খেতে বসেছে শতশত বসতবাড়ি-দোকানপাট

৮ জুলাই : নামাজের সময়সূচি

১০

সোমবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

১১

আজ চীন যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী

১২

যান্ত্রিকতার যুগে বিলুপ্ত প্রায় গরু দিয়ে হাল চাষ

১৩

হাসপাতালে খালেদা জিয়া

১৪

হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে খালেদা জিয়াকে

১৫

দশ লাখ টাকার মাছ জব্দ, এতিমখানায় বিতরণ

১৬

হঠাৎ অসুস্থ খালেদা জিয়া, নেওয়া হবে হাসপাতালে

১৭

গলা পানি পেরিয়েও ত্রাণ পেলেন না তারা

১৮

ক্রুসকে ক্ষমা করে দিয়েছেন পেদ্রি

১৯

চিনি ও মোটরসাইকেলের চালান ধরে ফেলল ছাত্রলীগ

২০
X