সিলেট ব্যুরো
প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০২৪, ০৭:৩৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, পানিবন্দি ৬ লাখ মানুষ

বন্যার পানিতে নিমজ্জিত সিলেট অঞ্চল। ছবি : কালবেলা
বন্যার পানিতে নিমজ্জিত সিলেট অঞ্চল। ছবি : কালবেলা

তিন দফা বন্যায় নিঃস্ব সিলেটের মানুষ। ভোগান্তির শেষ নাই মানুষের। বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন ব্যবস্থার তীব্র সংকটের কারণে পানিবাহিত রোগবালাইয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সুরমা-কুশিয়ারার পানি কোথাও এক সেন্টিমিন্টার কমলেও অন্য পয়েন্টে বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে আছেন কুশিয়ারাপাড়ের মানুষ। জকিগঞ্জের প্রায় পুরো এলাকা পানির নিচে নিমজ্জিত।

সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাটসহ সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোয় কিছু পানি কমলেও বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জে পানি বেড়েছে। তবে সিলেটের উত্তর-পূর্ব উপজেলা জকিগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর বেশ কয়েকটি পয়েন্টে ডাইক ভেঙে প্রবল স্রোতে পানি প্রবেশ করে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পৌর এলাকার নরসিংহপুরসহ কয়েকটি এলাকায় ডাইক ভেঙে ও ডাইক উপচে নদীর পানি লোকালয়ে ঢুকে প্রায় ৮৫টি গ্রামের লাখো মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।

বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে উপজেলার নিম্নাঞ্চলের লোকজনের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বন্যাকবলিত এলাকার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ গোরস্থানসহ গ্রামীণ রাস্তাঘাট এবং শেওলা-জকিগঞ্জ সড়কের একটি অংশ পানিতে তলিয়ে গেছে। চলমান পরিস্থিতিতে রান্না করা খাবার, বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন, পানিবাহিত রোগবালাই ও গবাদিপশুর খাবার সংকটে চরম দুর্ভোগে বানভাসীরা।

বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) বিকেলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জেলার ১৩ উপজেলায় ৯৬টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। ১ হাজার ১৬০টি গ্রামের ৬ লাখ ১৭ হাজার ৭৯৩ জন মানুষ বন্যায় আক্রান্ত। জেলার ৬৪৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখন পর্যন্ত ৯ হাজার ২৩৪ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। ১২৬টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন ও প্রত্যেক উপজেলা প্রশাসন কার্যালয়ে কন্ট্রোল স্থাপন করে বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। প্রতি ইউনিয়নে মেডিকেল টিম গঠন করে বন্যার্ত অসুস্থ মানুষকে দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা।

বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সুরমা কুশিয়ারার সবকটা পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উজানের উপজেলাগুলো থেকে পানি নামতে থাকায় ভাটির উপজেলাগুলোর নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।

এদিকে নগরের ভেতরে বিভিন্ন এলাকা সকাল পর্যন্ত জলাবদ্ধ অবস্থায় আছে। বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় অনেক বাসিন্দা আশ্রয়কেন্দ্র অবস্থান করছেন। অনেকেই আবার ঠাঁই নিয়েছেন স্বজনদের বাড়িতে।

গত ২৯ মে ভারি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটে প্রথম বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ৮ জুনের পর পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়। এরপর বন্যার দ্বিতীয় ধাক্কা আসে ১৬ জুন। সেদিন আবার পাহাড়ি ঢলে সিলেটের সীমান্তবর্তী দুই উপজেলা বন্যার কবলে পড়ে। পরে নগর এলাকাসহ জেলার ১৩টি উপজেলায় বন্যা দেখা যায়। গত ১৯ জুন অতিবর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ওইসব উপজেলায় বন্যা বিস্তৃত হয়। এরমধ্যে ১৭ জুন থেকে সুনামগঞ্জ জেলায় ফের বন্যা দেখা দেয়। পরে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায় তা বিস্তৃত হয়। ২৫ জুন থেকে সিলেট অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হতে শুরু করার মধ্যেই সোমবার (১ জুলাই) থেকে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নদীর পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতি আবারও গুরুতর আকার ধারণ করেছে।

বন্যার পানিতে প্লাবিত এলাকা পরিবর্তিত হলেও সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। বরং আগে থেকে পানি নিমজ্জিত এলাকাগুলোতে মানুষের দুর্ভোগ ও ভোগান্তি আরও বেড়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, পাহাড়ি ঢল ও ভারি বর্ষণের কারণে নদীগুলোতে পানি বেড়েছে। মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি বেশি হলে সিলেটে তার প্রভাব পড়ে। আমাদের দেশের বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বর্তমান বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, যা বুধবার ছিল বিপৎসীমার ৭৪ সেন্টিমিটার ওপরে। সিলেট পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারা নদীর পানি বিয়ানীবাজারের শেওলা পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জকিগঞ্জের অমলসিদ পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৫৪ সেন্টিমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ১০২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং শেরপুর পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী পরিচালক শাহ মো. সজিব হোসাইন জানান, বুধবার সকাল ৬টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে বৃষ্টি হয়েছে ১৮ দশমিক ৪ মিলিমিটার। তবে বৃহস্পতিবার থেকে বৃষ্টিপাত কমে আসতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।

জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফসানা তাসলিম জানান, এখন পর্যন্ত উপজেলার লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন। পাঁচটি আশ্রয়কেন্দ্রে ৩০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের পাশে রয়েছে প্রশাসন। জুন মাসের ৩০ তারিখে প্রতিটি ইউপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ওই বরাদ্দ এখন বিতরণ করা হবে। নতুন করে চাহিদা পাঠানো হবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, জেলার অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানি ৬টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উজানের উপজেলাগুলো থেকে ঢলের পানি নামতে থাকায় ভাটির উপজেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির কোথাও উন্নতি আবার কোথাও অবনতি হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতিতে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে, জৈন্তাপুর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের মানুষের চলাচলের একমাত্র রাস্তাটি বানের পানির ধাক্কায় ১৫০ ফুট পর্যন্ত ভেঙে গভীর খালের সৃষ্টি হয়। পরে স্থানীয়রা সেচ্ছাশ্রমে রাস্তা সংস্কার করে চলাচলের উপযোগী করে তোলেন।

মে মাসের বন্যায় রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় লক্ষ্মীপুর গ্রামে কোনো গাড়ি কিংবা মোটরসাইকেল প্রবেশ করতে পারছে না। তার ওপর গত ১৭ জুন দ্বিতীয় দফা ও ১ জুলাই তৃতীয় দফা বন্যায় প্লাবিত হলে এই রাস্তার ভাঙা অংশ দিয়ে প্রবল স্রোতে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে।

স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, প্রতিদিন এই সড়কে প্রায় ১০-১২ হাজার মানুষ যাতায়াত করে। তার মধ্যে বড় একটা অংশ হলো স্কুল ও কলেজ যাওয়া আসা করা শিক্ষার্থীরা। গত একমাস ধরে সীমাহীন কষ্ট উপেক্ষা করে ১ নং লক্ষ্মীপুর, ডুলটিরপাড়, চাতলারপাড় এলাকার মানুষ এই সড়কে যাতায়াত করছে। কোনো ধরনের গাড়ি চলাচল না করার ফলে বাজার সদাই, বস্তা, গ্যাস সিলিন্ডারের মতো ভারী পণ্য নিয়ে আনুমানিক ৫ কিলোমিটার এলাকায় চলাচল খুবই দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।

বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, গ্রামবাসী বাঁশ কেটে বাঁধ নির্মাণ করে রাস্তাটি চলাচলের জন্য উপযোগী করে তুলছে। এ সময় সংস্কার কাজের স্থান পরিদর্শনে আসেন ২নং জৈন্তাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম, সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন।

তিনি বলেন, উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি স্থানীয়দের সার্বিক সহযোগিতায় ১৫০ ফুট ভেঙে পড়া রাস্তা আজ এলাকাবাসীর সেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সংস্কার করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, চলতি বছর তিনদফা বন্যায় শুধু লক্ষ্মীপুর নয় বরং জৈন্তাপুর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে এরইমধ্যে সম্পূর্ণ, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তার তালিকা করে উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও পিআইও অফিসে জমা দেওয়া হয়েছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিক্ষোভে উত্তাল ইসরায়েল, অবরুদ্ধ রাজধানী

সাংবাদিককে প্রাণনাশের হুমকি দিলেন আ.লীগ নেত্রী রানী

সাপের কামড়ে শিক্ষার্থীসহ দুজনের মৃত্যু

মিডিয়া কি তবে আত্মহত্যায় প্ররোচনা জোগাচ্ছে!

জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় শেখ হাসিনার ভূমিকা বিশ্বে অন্যতম : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

রথযাত্রায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ৫ জনের মৃত্যু

বাবার স্বাধীন করা দেশ ব্যর্থ হতে পারে না : প্রধানমন্ত্রী 

এইচএসসি পরীক্ষায় দায়িত্বে অবহেলা, তিন শিক্ষককে অব্যাহতি

কোচের সঙ্গে সংঘর্ষে কেইনকে নিয়ে সংশয়

দেশের ১২ জেলায় নিয়োগ দেবে ইউএস-বাংলা

১০

বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি কমলেও বাড়ছে বন্যার্তদের দুর্ভোগ

১১

বিশ্বসেরা গোলকিপারকে চায় না ম্যানইউ

১২

ঢাবির হলে ছাদের পলেস্তারা খসে আহত শিক্ষার্থী 

১৩

রাফীর সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছে নেই দেবের

১৪

শাহবাগ অবরোধে কোটাবিরোধীরা, মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রলীগ 

১৫

খসে পড়ল ছাদের পলেস্তারা, আহত ৫ শিক্ষার্থী

১৬

তিস্তা প্রকল্পে ভারত-চীন একসঙ্গে কাজ করতে রাজি : ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী

১৭

শ্রীলঙ্কার মতো ভুল যাতে না হয়, সতর্ক থাকতে হবে : কাদের

১৮

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের মোড়েও অবরোধ

১৯

দুই বৈশ্বিক আসরের জন্য ভারতের অধিনায়ক ঘোষণা

২০
X