প্রকৃতিতে জন্মানো সবুজ উদ্ভিদ মিশ্রিদানা এক ধরনের ঔষধি গাছ। এটি মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ও নিরাময়ে বহুকাল আগে থেকেই ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে আধুনিক চিকিৎসার প্রসারের ফলে ঔষধি গাছের প্রতি অনীহা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার পরিবেশ থেকে অস্তিত্ব হারাচ্ছে ঔষধিগুণে ভরা মিশ্রিদানা গাছটি।
মিশ্রিদানা বা চিনিপাতা অথবা বন ধনে উদ্ভিদটির বৈজ্ঞানিক নাম স্কোপারিয়া ডুলসিস। এটি বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে জন্মে। উদ্ভিদটি দেখতে অনেকটা ধনিয়া গাছের মতো। এর ফলও ধনিয়ার মতো। এ উদ্ভিদটির ফুল ছোট, ফুলটির রং সাদা ও সুন্দর। উদ্ভিদটি সড়কের পাশে, বাড়ির আশপাশে, পুকুর পাড় ও পানি জমে না এ রকম পতিত জমিতে জন্মে থাকে। এর পাতা মিষ্টি স্বাদযুক্ত।
এটি একটি অন্যতম ভেষজ উদ্ভিদ। সাধারণত ৩০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। গাছটি ছোট হলেও দেখতে বেশ সুন্দর। গাঢ় সবুজ রঙের খাঁজকাটা ঘন পাতায় শাখা-প্রশাখাযুক্ত গাছ। এ গাছে সারাবছরই ফুল ধরে। তবে শরৎ ও বর্ষাকালে বেশি ফুল দেখা যায়। এরা পরিপক্ব বাদামি বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে থাকে।
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে, মিশ্রিদানা নানাবিধ রোগে খুবই উপকারী ও অন্যতম ভেষজ উদ্ভিদ। এটি দীর্ঘদিনের আমাশয় নিরাময়ে খুবই কার্যকরী ওষুধ। এ গাছের পাতা, শাখা-প্রশাখা, ফুল ও মূল কাঁচা বা শুকনো অবস্থায় নানা রোগে ব্যবহার উপযোগী। এটি ডায়াবেটিস ও রক্তচাপ রোগ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। গ্যাস্ট্রিক, আলসার, অরুচি ও বদহজমজনিত সমস্যায় বেশ উপকারী।
মুখের ঘা সারাতে এ উদ্ভিদের পাতা ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। গনোরিয়া রোগ নিরাময়ে এ গাছটির জুড়ি নেই। মিশ্রিদানা গাছ জণ্ডিস রোগ সারাতে বেশ উপকারী। এ ছাড়া বিষাক্ত পোকামাকড়ের কামড়ে সৃষ্ট জ্বালাপোড়া বা ব্যথা সারাতে এ উদ্ভিদটির ভূমিকা অপরিসীম। এ ছাড়া যৌন দূর্বলতায় উদ্ভিদটি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় একসময় সচরাচর এ উদ্ভিদটি চোখে পড়লেও দিন দিন উদ্ভিদটির উপস্থিতি কমে আসছে। একসময় মানুষ এসব ভেষজ উদ্ভিদ দিয়েই নানা রোগ নিরাময় করতেন। তবে উন্নত চিকিৎসার প্রসার, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর নির্মাণের কারণে বনায়ন স্বল্পতায় মিশ্রিদানার মতো অনেক ঔষধি গাছ বিলুপ্তির হুমকিতে পড়েছে। এতে আগামী প্রজন্ম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত ভেষজ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় প্রবীণরা।
উপজেলার দুলালপুর ইউনিয়নের বালিনা এলাকার বাসিন্দা আলফু মিয়া বলেন, একসময় অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হলে প্রকৃতিতে জন্মানো নানারকম লতা, পাতা, গাছ দিয়েই চিকিৎসা দেওয়া হতো। এতে অসুখ-বিসুখও সেরে যেত। এ আধুনিক সময়ে এসে এখন আর কেউ গাছগাছালির মাধ্যমে চিকিৎসা গ্রহণ করছে না। গাছগাছালির প্রতি দিন দিন অবহেলা বৃদ্ধি পাওয়ায় ঔষধি গাছ প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইউনানি চিকিৎসক ডা. সোহেল রানা কালবেলাকে বলেন, মিশ্রিদানা বা চিনিপাতা উদ্ভিদটির কাণ্ড ও পাতাতে এমিলিন নামক একপ্রকার যৌগ রয়েছে। আর এ যৌগের উপস্থিতির কারণে এটি মধুমেহ রোগ নিবারক। এ উদ্ভিদটি প্রাচীনকাল থেকেই মানবদেহের নানা রোগ নিরাময়ে ব্যবহার হয়ে আসছে।
তিনি বলেন, ভেষজ চিকিৎসার উপকরণ দিন দিন পরিবেশ থেকে কমে যাচ্ছে। এসব উপকারী উদ্ভিদ রক্ষায় আমাদের সকলকে যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। এতে পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা পাবে।
মন্তব্য করুন