প্রজননকাল বিবেচনায় ১ জুন থেকে ৩০ আগস্ট মোংলা উপকূলের নদী ও খালে মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ করে সরকার। একইসঙ্গে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল সব পেশাজীবী ও পর্যটকদের বনে প্রবেশের ওপর দেওয়া হয় নিষেধাজ্ঞা। মাছ ধরার ওই নিষিদ্ধ সময়ে সুন্দরবন সংলগ্ন মোংলা উপকূলের নদ-নদীতে নির্বিচারে চলছে চিংড়ি পোনা আহরণ।
উপকূলের শত শত নারী-পুরুষ নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে চিংড়ি পোনা ধরতে গিয়ে ধ্বংস করছে ১শ প্রজাতির জলজ প্রাণি। বছরের পর বছর ধরে নির্বিচারে পোনা আহরণের ফলে প্রাকৃতিক উৎসে হ্রাস পাচ্ছে মাছের উপস্থিতি।
জানা যায়, প্রাকৃতিক পোনার ওপর ভিত্তি করে আশির দশকে বাংলাদেশে শুরু হয় উপকূলীয় অঞ্চলে লবণ পানির চিংড়ি চাষ। গত তিন দশকে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চিংড়ি চাষের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। আর ওই ঘেরগুলোতে চিংড়ি পোনার ব্যাপক চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য সহজ পন্থা হওয়ায় উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ নির্বিচারে নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে বাগদা-গলদা পোনা আহরণ করছে নদী ও খাল থেকে।
আবার ওইসব পোনা দিনের আলোতে দোকান বা বাজারে আড়ৎ বসিয়ে চলছে বেচা বিক্রি, যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। তবে যারা এর সঙ্গে জড়িত, তারা দিচ্ছেন নানা অজুহাত। তারা বলছেন, নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারের জন্য আড়ৎদার আর প্রভাবশালীদের মাধ্যমে বন বিভাগ ও প্রশাসনের কিছু দুর্নীতিবাজদের দিচ্ছেন মাসোয়ারা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মোংলা বন্দরের পশুর নদের কানাইনগর থেকে জয়মনি খাদ্য গুদাম পর্যন্ত শত শত জাল দিয়ে পোনা ধরছে নদী কূলের বাসিন্দারা। একইসঙ্গে প্রভাবশালীরা সাতক্ষীরা ও কয়রা এলাকা থেকে জেলেদের চুক্তির মাধ্যমে এনে পোনা মাছ ধরতে নামিয়ে দিয়েছেন নদীতে।
পোনা আহরণে থাকা মরিয়ম বেগম (৪৮) জানান, এখন মাছ ধরা নিষেধ এবং জাল ব্যবহারও নিষেধ সবই তারা জানেন। তারপরও পেটের দায়ে মাছ ধরতে নেমেছেন।
জেলে মিজানুর রহমান তোতা জানান, মহাজনের মাধ্যমে তারা বন বিভাগ, প্রশাসন ও অন্যন্য দপ্তর ম্যানেজ করে মাছ ধরেন। এই পোনা বিক্রি করে যে টাকা উর্পাজন হয় তা দিয়ে চলে তাদের সংসার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৩২ বছর বয়সী জয়মনি এলাকার বাসিন্দা এক জেলে বলেন, প্রশাসন আর বন বিভাগকে চাঁদা দিয়ে তারা মাছ ধরেন। সিজন শেষে তারা মহাজনের টাকা পরিশোধের পর খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হয়। কিছু দিন পেট চলে এটুকু তাদের লাভ। তাদের পুঁজি করে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় মধ্যভোগী প্রভাবশালী, বন বিভাগ ও প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা।
সুন্দরবনের করমজল কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির জানান, নিষিদ্ধ জাল দিয়ে চিংড়ি পোনা ধরতে গিয়ে নষ্ট করা হচ্ছে অন্য মাছের শত শত পোনা। এর ফলে এক সময় মাছের আকাল দেখা দেবে মোংলা উপকূলের নদী ও খালে।
মোংলা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অঞ্জন বিশ্বাস জানান, ১ জুন থেকে ৩০ আগস্ট তিন মাস মাছের প্রজনন মৌসুম। তাই উপকূলের নদী ও খালে মাছ আহরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার। সরকারি এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
মোংলা চাঁদপাই নৌ থানার ওসি মো. আক্তার মোর্শেদ জানান, কোস্টগার্ড ও মৎস্য বিভাগের সঙ্গে তারা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করেন। তারপরও কীভাবে নদীতে এত জাল? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, যদি থেকে থাকে তারা আবারও অভিযান পরিচালনা করবেন।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী নুরুল কবির জানান, পশুর নদে পোনা ধরা বা অন্য মাছ ধরা বন্ধ করা তাদের দায়িত্ব নয়। যেহেতু ওই নদী বন বিভাগের আওতায় নয়। এ দায়িত্ব জেলা প্রশাসন বা উপজেলা প্রশাসনের।
এদিকে মোংলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত তামান্না জানান, প্রজননকালীন সময়ে মৎস্য আহরণ বন্ধ থাকলে ক্ষতির মুখে পড়ে জেলেরা। তাই ক্ষতিপূরণ হিসেবে জেলেদের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। দ্রুত সময়ের মধ্যে তালিকাভুক্ত জেলেদের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন