নিয়মিত তদারকির অভাবে যাত্রীদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে। দেশের উওর-পশ্চিমাঞ্চলের আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি যাত্রী নিয়ে চলাচল করায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে।
সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, ১৯৬৭ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই ৫০ বছরে ২ হাজার ৫৭২টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় সম্পদের ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার ৪১৭ কোটি ২০ লাখ টাকার। দীর্ঘ এ সময়ে দুর্ঘটনাকবলিত নৌযানের সংখ্যা ২ হাজার ৬৭২টি। এর মধ্যে ৯০১টি নৌযান উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
দেশের বিভিন্ন নদী পথে চলাচলকারী অধিকাংশ লঞ্চ ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী বহন করছে। বিশেষ করে ছুটির দিনে এবং উৎসবের সময় যাত্রী সংখ্যা এতটাই বৃদ্ধি পায়, লঞ্চগুলো যাত্রীতে ঠাসা। এতে লঞ্চের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা যেমন থাকে, সামান্য ঝড় বা ঢেউয়ে লঞ্চ ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক গুণ বেড়ে যায়।
আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটের ১৪ কিলোমিটারে চলাচলকারী ১৩টি লঞ্চের বেশিরভাগই ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে। মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার আরিচা লঞ্চঘাটে সরেজমিনে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে মেলে এর সত্যতা।
পাবনার কাজিরহাট থেকে ছেড়ে আসা মেসার্স হালিম এন্টারপ্রাইজের লঞ্চ এমভি অনিকা-২ আরিচা ঘাটে পৌঁছায় দুপুর ১২টার দিকে। সে সময় দেখতে পাওয়া যায় লঞ্চের ধারণ ক্ষমতা ১০৮ জন যাত্রীর থাকলেও, কাজিরহাট প্রান্ত থেকে ওই লঞ্চ যাত্রী নিয়ে আসে ৩২০ জন। এ ছাড়াও নেই পর্যাপ্ত পরিমাণ লাইফ জ্যাকেট ও বয়া।
কাজিরহাট থেকে ঢাকাগামী যাত্রী রেহানা আক্তার বলেন, নৌপথে যাতায়াতই আমাদের একমাত্র ভরসা। লঞ্চ মালিক ও স্টাফরা বরাবরই গাদাগাদি করেই যাত্রী দিয়ে তারপর লঞ্চ ছাড়ে। দীর্ঘসময় পরপর লঞ্চ ছাড়ার কারণে সময় বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হই আমরা।
পাবনা সদর থেকে সাভারগামী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমাইয়া খানম বলেন, এ নৌপথে লঞ্চ মালিকদের কাছে জিম্মি যাত্রীরা। মালিকপক্ষের খেয়াল খুশি মতো ভাড়া আদায় আর ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি যাত্রী নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই এ পথে লঞ্চ চলাচল করে। কিন্তু এগুলো দেখবে কে? যারা তদারকি করবেন তারাইতো মাসোহারা নিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকেন। যাত্রীদের জীবন বিপন্ন হলেও কর্তা-বাবুদের কিছুই যায় আসে না। তাদের মাস শেষে মাসোহারা পেলেই সব ঠিক হয়ে যায়।
গোলাম মওলা নামে আরেক যাত্রী বলেন, অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই করে লঞ্চগুলো দীর্ঘদিন ধরেই চলছে এ পথে। কিন্তু কোনো যাত্রী প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না। যদিও কেউ প্রতিবাদ করে। তাহলে ওই যাত্রীকে হেনস্তার শিকার হতে হয় লঞ্চ মালিকদের লালিত কর্মচারীদের হাতে।
যাত্রীরা আরও বলেন, আমাদের অনেক সময় ইচ্ছার বিরুদ্ধে এমন লঞ্চে চড়তে হয় যেখানে অতিরিক্ত ভিড় থাকে। কিন্তু পর্যাপ্ত লঞ্চ না থাকায় আমাদের অন্য কোনো উপায় থাকে না।
এদিকে নৌপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লঞ্চগুলোর নিয়মিত তদারকি এবং যাত্রী ধারণ ক্ষমতা মেনে চলার ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা এবং নিয়মিত তদারকির অভাবে এ ধরনের বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে।
এ ব্যাপারে আরিচা লঞ্চঘাটের ম্যানেজার জুয়েল হোসেন মোবাইল ফোনে বলেন, ঈদ ছাড়া লঞ্চে অতিরিক্ত কোনো যাত্রী পরিবহন করা হয় না। আর চা-নাস্তা বাবদ ঘাটের দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিএর ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই)-কে কিছু খরচ দেওয়া হয়। তবে প্রতিদিন না।
কালবেলার অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিদিন চা-নাস্তা আর দুপুরে খাবার বাবদ ঘাটের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিআইডব্লিউটিএর ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) আফছার ও জসিম ৫০০ টাকা নেন লঞ্চ কাউন্টার থেকে।
এ বিষয়ে আরিচা ঘাটের বিআইডব্লিউটিএর ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) আফছার আলী বলেন, অনেক সময় ধারণ ক্ষমতার চেয়েও বেশি যাত্রী নিয়ে লঞ্চ চলে যায় আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে। তবে আমরা সবসময়ই তাদের সতর্ক করি, যাতে অতিরিক্ত যাত্রী বহন না করে। আর চা-নাস্তা খরচের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি এটা নেই না, অন্য কেউ নেয় কি না আমার জানা নেই।
এ ব্যাপারে আরিচা (বিআইডব্লিউটিএর) সহকারী উপপরিচালক, বন্দর ও পরিবহন কর্মকর্তা আল মামুন অর রশিদ কালবেলাকে বলেন, আপনি কী বলেন এসব, এখন যাত্রীর কোনো চাপই নেই। আপনি হোয়াটসঅ্যাপে আসুন, হোয়াটসঅ্যাপে আপনাকে সব দিচ্ছি।
এ ছাড়াও ট্রাফিক ইন্সপেক্টরদের লঞ্চ কাউন্টার থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে রাগান্বিত হয়ে তিনি বলেন, আগে আমাকে প্রমাণপত্র দিন তারপর আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলব।
মন্তব্য করুন