প্রথম পরিচিতি মিছিল থেকে, এরপর ধীরে ধীরে বুনে যায় গ্যাংয়ে! বলছিলাম, চট্টগ্রামবাসীর আতঙ্ক কিশোর গ্যাংয়ের কথা। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অনেক স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীও এসব গ্রুপের সদস্য। চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ, কোতোয়ালি, চান্দগাঁও এলাকায় এদের সংখ্যা বেশি। তাদের হাত দিয়েই ঘটে এলাকায় অধিপত্য বিস্তারসহ, খুন, দখল, চাঁদাবাজি, অপহরণ, ইয়াবা বিক্রি ইত্যাদি কার্যকলাপ। একপর্যায়ে এলাকার কথিত বড় ভাইয়েরা নিজেদের অস্তিত্বের শক্তির জানান দিতে তাদের মাথার ছাতা হয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর কথিত বড় ভাইদের ছায়া পেয়ে এলাকায় যে কোনো তাণ্ডব চালাতে দ্বিধাবোধ করে না কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ২৫০টিরও বেশি। তাদের নিয়ে উৎকণ্ঠায় নগরবাসী। তারা বলছেন, দিনের পর দিন এই গ্যাং সদস্যদের বিস্তার বাড়ছে। গ্রেপ্তারের পরও তাদের মূল শেকড় উৎপাটন হচ্ছে না। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, কিশোর গ্যাং দমনে মাঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সজাগ রয়েছে। চলতি বছর প্রথম তিন মাসে ২৬টি গ্যাংয়ের ১৫০ জন সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে। পাশাপাশি অভিযানও অব্যাহত রয়েছে।
জানা গেছে, প্রথমে মিছিলে ভাড়ায় খাটে তারা। পরে ধীরে ধীরে গ্যাংয়ে রূপ ধারণ। দলীয় কোনো পদ পদবি বা সদস্য পদে নাম না থাকলেও দলের নাম ভাঙিয়ে চলে তাদের কর্মকাণ্ড। পরে তাদের কর্মকাণ্ডের ফলাফলের ওপর নির্ভর করে কথিত বড় ভাইদের কাছে বাড়ে গ্রহণযোগ্যতা। তাদের হাতে পৌঁছে যায় বড় ভাইদের দেওয়া উপহার (দামি মোবাইল ফোন) সহ আরও কত কী। বড় ভাইয়ের উপহারে সন্তুষ্টি হয়ে তার দিক নির্দেশনা মেনে চলে কিশোর গ্যাং সদস্যরা।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে একাধিক কিশোর গ্যাং সদস্যরা জানায়, বড় ভাইদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তারা মাঠ তাতায়। চলে দলের নাম ভাঙিয়ে। তাদের চালিকা শক্তি বড়ভাই। তাদের বিরুদ্ধে থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ হলে বড় ভাইরা দেখভাল করে। বড় ভাইদেরও বিভিন্ন ব্যবসা আমরা চালাই।
অভিযোগ আছে, নগরে আতঙ্কের নাম কিশোর গ্যাং। সড়কে, স্কুলের পাশে, বিপণিবিতানসহ বিশেষ করে মফস্বল এলাকায় দল বেঁধে তাদের আড্ডা। ইভটিজিং থেকে শুরু করে অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখল, মাদক ব্যবসা ইত্যাদি করে। দলীয় মিছিল-মিটিংয়ে তাদের অংশগ্রহণ। দলের নাম ভাঙিয়ে শুরু হয় পথচলা। দলীয় মিছিলে জনসমাগম দেখিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের নজরে আসতে স্থানীয় ওযার্ড নেতারা মরিয়া হয়ে ওঠে। পরে তারা সহযোগিতা নেয় ওই সব কিশোর গ্যাংয়ের। আস্তে আস্তে ওই গ্যাং থেকে তৈরি হয় পাতি নেতা। তারা নিজেদের অস্তিত্ব ও বড় ভাইয়ের শক্তির জানান দিতে এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। তাদের ভয়ে কেউ মুখ খুলে না। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে থানায় পৌঁছানোর আগেই কথিত বড় ভাইদের তদবিরে ছেড়ে দেয়।
আগ্রাবাদের ভাসমান দোকানি আকবর হোসেন কালবেলাকে বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের অত্যাচার দিনের পর দিন বাড়ছে। ভাসমান চায়ের দোকান করি কিন্তু দিতে হয় টাকা। দোকান বসালে তাদের এককালীন কিছু দিতে হয়। এরপর দৈনিক টাকা দিতে হয়। বেপারিপাড়া থেকে শুরু করে লাকি প্লাজা, সাউথল্যান্ডের সামনে, আগ্রাবাদ গুলজার কমিউনিটি সেন্টার, আগ্রাবাদ বাদামতলীসহ যত ফুটপাতে ভাসমান দোকানি আছে প্রত্যেককে জায়গা ভেদে এককালীন এবং প্রতিদিন ১০০-২০০ টাকা দিতে হয়।
তাদের নাম জানতে চাইলে ওই দোকানি বলেন, দলীয় নাম ভাঙিয়ে তারা টাকা নেয়। নেতাদের সঙ্গে দেখি। নাম বললে তো ওরা আমার ওপর অত্যাচার করবে, বসতে দিবে না। আমার পেটে লাথি পড়বে।
তথ্যমতে, ২০১৯ সালের ৫ এপ্রিল নগরীর চান্দগাঁও থানার ফরিদের পাড়া এলাকায় চাঁদা চেয়ে না পেয়ে আমজাদ হোসেনের পায়ে ড্রিল করে কিশোর গ্রুপের সদস্যরা। যুবলীগ নামধারী এক বড় ভাইয়ের নেতৃত্বে এলাকায় নানা অপরাধে জড়িত ছিল ওই কিশোর গ্রুপ। একই বছরের ১৪ এপ্রিল কোতোয়ালি থানার কাজির দেউড়ির ব্যাটারি গলি এলাকায় ইয়াবা সেবনের টাকা না পেয়ে বাবা রঞ্জন বড়ুয়াকে ছুরিকাঘাতে খুন করে ছেলে রবিন বড়ুয়া। বাবাকে হত্যাকারী রবিনও কিশোর বয়সি। এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
২০১৯ সালে নগরীর ৩০০ স্পটে সক্রিয় থাকা ৫৫০ কিশোর গ্যাং সদস্যের তালিকা করে সিএমপি। তাদের দমাতে শুরু করে অভিযান। অভিযানের মুখে বছরের শেষ দিকে দাপট কিছুটা কমলেও বন্ধ হয়নি কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা। প্রতি বছর গ্যাংয়ে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন সদস্য। গত কয়েক বছরে চট্টগ্রামে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে কিশোর অপরাধীরা। একের পর এক খুন, মাদক চোরাচালান, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব ও আধিপত্য বিস্তারে জড়াচ্ছে।
পাহাড়তলী থানাধীন সাগরিকা বিটাক এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে ইলিয়াছ দুটি কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে। মেয়েঘটিত বিষয় নিয়ে দুই গ্রুপে তর্কে জড়ালে তাদের ইলিয়াছের অফিসে ডাকা হয়। সেখানে উভয় গ্রুপের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হলে ফয়সাল, বাবু, বিপ্লব, কার্তিকসহ আরও ১০-১৫ জন মিলে মাসুম এবং সজিবকে এলোপাতাড়ি ছুরি মেরে মারাত্মক আহত করে।
পরে তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা দুজনকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার পর জড়িতদের গ্রেপ্তারে ডিবি (পশ্চিম ও বন্দর) কাজ শুরু করে। কক্সবাজার যাওয়ার পথে চকরিয়া হতে মো. ইলিয়াছ গ্রেপ্তার হয়। সাগরিকা বিটাক মোড়ে ইলিয়াছের একটি অফিস রয়েছে। সে অফিসে বসে দুটি কিশোর গ্রুপকে পরিচালানা করে ইলিয়াছ। ইলিয়াছের নেতৃত্বে যেসব কিশোর রয়েছে তাদের মধ্যে বিটাক এলাকার-মো. আজাদ, মো. রমজান, পারভেজ তালুকদার ওরফে বরিশাইল্ল্যা পারভেজ, মো. হানিফ, মো. হারুন, মো, সম্রাট আকবর, মো. মারুফ, মো. রিয়াজ, মো. জনি, রবিউল ও নজরুল অন্যতম। এসব কিশোরের মাধ্যমে বিটাক এলাকার শিল্প-কারখানাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
একে খান এলাকায় শহীদ, কর্নেলহাট শাহীর পাড়া এলাকায় খালেদ, রাকিব, মিজান মুন্না, উত্তর পাহাড়তলী জোলাপাড়া এলাকায় লাল মানিকসহ আরও অনেকেই আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এলাকায় উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। ৯নং উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহিরুল আলম জসিমের বিরুদ্ধেও কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ওই এলাকার যুবলীগ নেতা বেলাল উদ্দিন জুয়েল, তারেক জামাল, ওসমান, আরিফ, ইউনুস, বিশ্ব কলোনিতে মোশাররফ হোসেন তুহিন বাহিনী আকবরশাহ এলাকায় ইসমাইল, গোলপাহাড় এলাকায় আনোয়ারুল আজিম একজন জনপ্রতিনিধি নেতৃত্বে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করছে।
চান্দগাঁও এলাকায় কিশোর গ্যাং ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। জামাল খান ও চকবাজার ওয়ার্ডেও কিশোরগ্যাংয়ের অপতৎপরতা রয়েছে। নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের ৩০০ স্পটে বিশেষ করে উঠতি বয়সি কিশোররা বড়ভাইদের মাধ্যমে গ্যাংয়ে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। তারা মাদক ব্যবসা, ইয়াবা সেবন, মোটরসাইকেল ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়াচ্ছে। সামান্য বিষয় নিয়ে খুনোখুনিতে লিপ্ত হচ্ছে তারা।
কোতোয়ালি থানাধীন রিয়াজউদ্দিন বাজার ফলমুন্ডি এলাকায় ইদু বাহিনী, স্টেশন রোডের পশ্চিমে মামুন ও ইকাবাল দুইভাই প্রকাশ্যে চাঁদা আদায়সহ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে। এছাড়া চলতি বছর ১লা মে ফিরিঙ্গী বাজার চেয়ারম্যান ঘাট এলাকার কিশোর গ্যাং লিডার ডোম আসিফ গ্রুপের প্রায় ১০০ জন কিশোরের সশস্ত্র মহড়া দেয়। মহড়াটি আলকরন মসজিদ হয়ে চক্রবর্তী কলোনি হয়ে ১১ তলায় গিয়ে ভাঙচুর এবং নগর কমিউনিটি সেন্টারের সামনে সিএনজি ভাঙচুর করে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে অন্তত অর্ধশত খুনের ঘটনা ঘটেছে। তাদের দৌরাত্ম্য কমাতে গত চার বছর আগে তালিকা করা হলেও সেটি আর হালনাগাদ করা হয়নি। ফলে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে পাড়া-মহল্লার উঠতি বয়সী কিশোররা।
যদিও কিশোরগ্যাংয়ের তালিকা হালনাগাদের কাজ চলমান রয়েছে জানিয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্) প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়া কালবেলাকে বলেন, কিশোরগ্যাং একটি সামাজিক অস্থিরতা। আমাদের আইনি কাজ চলমান রয়েছে। এর পাশাপাশি আমরা সামাজিকভাবে কিশোরদের অভিভাবকদের মাধ্যমে মোটিভেশন করার কাজও চলমান রয়েছে। মূলত আমরা দুটো কাজই চালিয়ে যাচ্ছি। তাছাড়া কাজগুলো একদিনে শেষ করা সম্ভব নয়। মাদকের বিরুদ্ধেও আমাদের বিশেষ অভিযান চলমান রয়েছে। আমরা প্রতিমাসেই এই কার্যক্রম পরিচালনা করি। আমাদের স্পেশাল ড্রাইভে আমরা মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা ধরে অভিযান করে থাকি।
মন্তব্য করুন