অভিযোগ যেন পিছু ছাড়ছেই না চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। বারবার আসামির কাঠগড়ায় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এবার তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভয় ও হুমকি দিয়ে ৩ লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
জানা যায়, এবার কলেজে ভর্তি হয়েছে মোট ৩ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী। যাদের কাছ থেকে খাম বিক্রি বাবদ আদায় করা হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। যার প্রকৃত মূল্য ৯ হাজার ৬০০ টাকা।
তবে সভাপতি ও সম্পাদকের এমন চাঁদাবাজির ঘটনায় জড়িত হতে চান না বাকি ছাত্রলীগের পদধারী কেউই। তাই এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে তারা। কিন্তু প্রতিবাদ জানিয়ে উল্টো হামলার শিকার হতে হয়েছে তাদের। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি দুই ছাত্রলীগের কর্মী। শুধু এ দুজনই নয়, চাঁদাবাজির প্রতিবাদ জানানোর ঘটনায় ঘটেছে সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া।
বৃহস্পতিবার (৯ মে) পর্যন্ত অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন।
তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সুভাস মল্লিক সবুজ। তিনি অভিযোগ করে বলেন, তাদের পদ থেকে সরাতেই এমন মিথ্যা কথা ছড়ানো হচ্ছে।
জানা যায়, বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম কলেজ প্রাঙ্গণে সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে সভাপতি-সম্পাদকের সঙ্গে আরেকটি গ্রুপের। এই ঘটনায় ১০ জন আহত হন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি হন দুজন। তাদের অবস্থা গুরুতর।
আহতরা হলেন, ইংরেজি ১ম বর্ষের জাবের বিন জাফর, ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ইমতিয়াজ হোসেন সাবের, ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগের সহসম্পাদক রিয়াজ উদ্দীন, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র আবদুল মাজেদ ফয়সাল, চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের উপবিজ্ঞান প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক ও ডিগ্রি ১ম বর্ষের ছাত্র মাহিবি তাজোয়ার, চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের উপপাঠাগারবিষয়ক সম্পাদক ও ডিগ্রি ৩য় বর্ষের ছাত্র এরফান আলম ও আমিন ফয়সাল বিদ্যুৎ।
সভাপতি-সম্পাদক গ্রুপের আহত ছাত্রলীগ নেতারা হলেন, ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের সাধারণ সম্পাদক জনি, ইসতিয়াক হোসেন ও মো. মিজান।
সংঘর্ষের কারণ সম্পর্কে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অর্নব দেব বলেন, চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন ধরে অনৈতিকভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছে। বর্তমানে অনার্সে ভর্তি চলছে। প্রত্যেকটি শিক্ষার্থী থেকে একটি খাম বিক্রি বাবদ ১০০ টাকা করে নিচ্ছে। এছাড়া রেজিস্ট্রেশন কার্ড, এডমিট কার্ড নিতে হলে প্রত্যেকটি থেকে ১০০ টাকা করে নিচ্ছেন সভাপতি-সম্পাদক। অথচ শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যেন কোনো চাঁদাবাজি না করা হয়। এই সব নিয়ে কয়েকদিন ধরেই আমরা প্রতিবাদ করে আসছি। আজকেও (বৃহস্পতিবার) একজন সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে অন্যায়ভাবে জোরপূর্বক ১০০ টাকা নেওয়ার চেষ্টা করে। পরে আমরা প্রতিবাদ করায় তারা আমাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
অর্নব দেব আরও বলেন, শুধু আজ নয়, বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে এমন চাঁদাবাজি তারা দীর্ঘদিন ধরেই করছেন। এমন ঘটনার প্রতিবাদে চকবাজার থানা ও কোর্টে আমরা মামলাও করেছি। আজ যখন সাধারণ শিক্ষার্থীর গায়ে হাত তোলা হয় তখনই আমরা প্রতিবাদ করি।
বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ক্যাম্পাসে চাঁদাবাজির পাশাপাশি নিয়োগ বাণিজ্য, টেম্পোস্টেশন ও টং দোকান থেকেও প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণে চাঁদাবাজি করত বলে অভিযোগ চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সহসভাপতি মনিরুল ইসলাম মনিরের।
তিনি বলেন, এসব চাঁদাবাজি করে কলেজ সভাপতি মাহাদুল করিম সাড়ে ৩ কোটি টাকায় একটি বিশাল বাড়ি বানিয়েছেন। তাদের দুই জন এতটাই বেপরোয়া যে, তাদের কাছে সবাই অসহায়। তারা একটি কলেজে কীভাবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সামান্য ৩ টাকা দামের খাম ১০০ টাকা আদায় করছে! তবে আমরা এর প্রতিবাদ জানাই। এই কারণে আমাদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। আমরা চাই এই ধরনের মানুষ যেন ক্যাম্পাসে আর না আসে। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে। আমরা চাঁদাবাজি চাই না।
ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীদের কাছে জোর করে খাম বিক্রি করে গেল ৭ দিনে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক আবদুল্লাহ আল সাইমন।
তিনি বলেন, কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদক সিন্ডিকেট করে ভর্তি কার্যক্রমের ফাইল বিক্রি করছে। একটি খামের জন্য ১০০ টাকা চাওয়ার ঘটনায় প্রতিবাদ জানালে ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ছাত্র ইমতিয়াজ হোসেন সাবেরের ওপর গেল কয়েকদিন আগে হামলা করে সভাপতি-সম্পাদকের অনুসারীরা। এ সময় তার চোখের ওপরের অংশ জখম হয়। আমরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাই। সে সুস্থ হয়ে আজ ক্যাম্পাসে আসে। আজও তার ওপর হামলা করা হয়। আজ তার কানই ফাটিয়ে দেওয়া হয়। পরে এ নিয়ে আমাদের দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, এই খাম বিক্রি বিষয়টি সভাপতি ও সম্পাদকের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করেন হাবিব উল্ল্যাহ রিয়াদ ও মমিনুল ইসলাম নামে দুই ছাত্রলীগ নেতা। প্রত্যেকটি ছাত্রকে তারা ভয়ভীতি ও হামলা-মারধরের হুমকি দিয়েই এই টাকা আদায় করছে। আমিসহ আমাদের কিছু ছাত্রলীগ সহকর্মী এই চাঁদাবাজির প্রতিবাদ জানাই এবং তাদের সঙ্গ ছেড়ে দিই।
তবে সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মল্লিক সবুজ। তিনি বলেন, গেল এক মাস ধরে আমাকে ও সভাপতিকে কলেজে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। কলেজে সভাপতি মাহমুদুল করিমের পোস্টার, ব্যানার ছিল। কিন্তু সেই পোস্টার, ব্যানার খুলে ফেলা হয়েছে। কলেজের পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য, টেম্পু স্টেশন ও টং দোকানসহ কোনো জায়গা থেকেই আমরা চাঁদাবাজি করি না। এটা একটা মিথ্যা অভিযোগ। এমন মিথ্যা অভিযোগ তুলে আমাদের হেয় করতে চাচ্ছে তারা। আজ বিনা-উষ্কানিতেই তারা আমাদের ওপর হামলা চালায়।
এদিকে এই ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মাহমুদুল করিমকে কয়েকবার ফোন করলেও ফোনটি রিসিভ হয়নি।
তবে বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানিয়েছেন চকবাজার থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) তৌহিদ কবির। তিনি বলেন, পূর্বের কিছু ঘটনার জের ধরেই চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মাহমুদুল করিম ও সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মল্লিক সবুজের অনুসারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের আরেকটি গ্রুপের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষই অভিযোগ করেননি।
মন্তব্য করুন