শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১
সাইদুল ইসলাম ও আসিফ পিনন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৪, ০৭:৫৪ পিএম
আপডেট : ২৫ মার্চ ২০২৪, ০৮:৪৭ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

ক্লাস পালিয়ে কিশোর হয়ে উঠছে ভয়ংকর, বাড়ছে উদ্বেগ

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়। ছবি : কালবেলা
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়। ছবি : কালবেলা

সময়টা ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪। দুপুরের দিকে চট্টগ্রাম নগরের গণি বেকারি এলাকায় কাঁধে ব্যাগ ও স্কুল ড্রেসে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন ছাত্র। এসময় জামালখানের দিক থেকে আরেকটি কিশোর গ্রুপ এসে সেখানে অবস্থান নেওয়ার পর শুরু হয় কথাকাটাকাটি। তারপর লাঠি, পরনের বেল্টসহ নানা উপকরণ কাজে লাগিয়ে শুরু করে মারামারি। সবশেষ ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় শেষ হয় ঘটনা।

চট্টগ্রামে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যকার বিরোধ, মারমারির কিংবা শেষটা এখানেই নয়। এর আগে ২০২২ সালে চট্টগ্রামের জামাল খান চেরাগী পাহাড় এলাকায় দুই দলের বাকবিতণ্ডার জেরে হাতাহাতি শুরু হলে কলেজছাত্র ইভান খুন হয় ছুরিকাঘাতে।

চট্টগ্রামের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা এভাবে যখন একের পর এক ভয়ংকর কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। তখন ক্লাস ফাঁকি দেওয়া কিশোরদের মধ্যে অপরাধের যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছে পুলিশ। এমনকি শুধু মারামারি নয় ক্লাস ফাঁকি শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ছেন মাদক গ্রহণ, বেচাকেনা, পর্নো আসক্তি, অনলাইন ভিত্তিক জুয়া, কিশোর গ্যাং কালচারসহ নানা অপরাধে। ক্লাস ফাঁকি দেওয়ায় এসব কিশোরদের আবার দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে। খোদ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) জরিপে ওঠে এসেছে কিশোরদের বেপরোয়া হয়ে ওঠার এমন চিত্র।

এ অবস্থায় নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিতি না থাকার কারণে শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে অনীহা সৃষ্টিসহ ৯ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার চিত্র তুলে আনা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। পাশাপাশি কিশোর অপরাধ থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে রাখতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম ৭০ শতাংশ উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা এবং উপস্থিতি নিশ্চিতের জন্য অভিভাবকদের কাছে ক্ষুদে বার্তা পাঠানোর পদ্ধতি চালুসহ ৫টি সুপারিশও করা হয়েছে এ প্রতিবেদনে।

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম মহানগরে শত শত স্কুল-কলেজ ও কয়েক লাখ শিক্ষার্থী আছে। সম্প্রতি মহানগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সামাজিক অস্থিরতা এবং কিশোর গ্রুপের উত্থান ও প্রসারের কারণ খুঁজতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে অনুপস্থিত থাকার বিষয়টি উঠে আসে। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মানদণ্ড নিরূপণে ক্লাসরুমে উপস্থিত থাকার ওপর বাধ্যবাধকতা না থাকায় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বিপদগামী হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস চলাকালে শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ বিভিন্ন পার্ক, রেস্টুরেন্ট ও খেলার মাঠে সময় কাটাচ্ছে। এসব শিক্ষার্থী জড়িয়ে পড়ছে অসামাজিক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে। এতে পরিবার ও সমাজের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাষ্ট্র।

আরও জানা যায়, ২০১৫ সালের ৩ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা পরিপত্রে এসএসসি পরীক্ষার জন্য নির্বাচনি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ন্যূনতম ৭০ শতাংশ উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয়। নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলেও ৭০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিত থাকলে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছিল এই নিয়মে। পরে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে ওই বছরের ৩ আগস্ট আদেশটি বাতিল করা হয়।

শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি বাধ্যবাধকতা না থাকার প্রভাব হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ক্লাসে উপস্থিত না থেকে শিক্ষার্থীরা কথিত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হয়ে কেউ যখন অন্য সহপাঠীর ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে, তখন স্বাভাবিক ভাবেই অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও ‘গ্যাং সদস্য’ হতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় কালবেলাকে বলেন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত উপস্থিত থাকলে বিপদগামী কাজ থেকে অনেকটাই দূরে থাকবে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের ৩টি স্কুলের ওপর এ জরিপ চালানো হয়েছে। এই জরিপে অনেক তথ্য উঠে এসছে। এতে দেখা গেছে শ্রেণিকক্ষে পালিয়ে অনেক শিক্ষার্থী অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। জরিপ শেষে এই বিষয়ে বেশ কিছু সুপারিশও দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে যেভাবে নানা অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলে তা অনেকটা কমে আসতে পারে। তাছাড়া সমাজের অপরাধ দমনে পুলিশও বদ্ধপরিকর। পাশাপাশি শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্বশীলরা, অভিবাবক, শিক্ষকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। উপস্থিতি নিশ্চিতের ব্যাপারে শিক্ষা বোর্ড থেকে কড়াকড়ি আরোপ করা যেতে পারে। তবে এখানে স্ব স্ব অবস্থান থেকেই সচেতনামূলক কাজ করলে সবার জন্য মঙ্গল এবং অপরাধ দমনে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারব বলে জানান তিনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশ, অভিভাবক ও শিক্ষার্থী সবার সমন্বয়ে স্কুল-কলেজের বিষয়ে কাজ করলে অনিয়ম, অপরাধ প্রবণতা থেকেই অনেকাংশে রক্ষা পাওয়া যাবে। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করে জনসচেতনতামূলক স্কুল-কলেজভিত্তিক কোনো কর্মতৎপরতা বা কর্মসূচি দিলে ভালো হবে।

মূলত চট্টগ্রাম মহানগরের ৩টি স্কুলের ওপর এ জরিপটি চালানো হয়েছে। যেখানে এসএসসি ও এইচএসসি শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার পর্যালোচনা করা হয়েছে। সিএমপি স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণি, গুল-এজার বেগম সিটি করপোরেশন মুসলিম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং আজেম আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এ জরিপ চালানো হয়।

জরিপের তথ্য মতে, সিএমপি স্কুল অ্যান্ড কলেজে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের দ্বাদশ শ্রেণিতে ৩৮৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৭০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিতি ছিল মাত্র ৮১ জনের, যা মোট শিক্ষার্থীর ২১ শতাংশ। ১৫৫ জন শিক্ষার্থী অর্ধেক ক্লাসও করেনি। গুল এ-জার বেগম সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের দশম শ্রেণিতে মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা ও বিজ্ঞান বিভাগে মোট শিক্ষার্থী ছিল ১১৬ জন। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ বার তার চেয়ে সামান্য কিছু বেশি ক্লাসে উপস্থিত ছিল মাত্র ৩৩ জন। অর্ধেকেরও কম ক্লাসে উপস্থিত ছিল ৬২ জন। এদের সবাই ছাত্রী।

অন্যদিকে কাজেম আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজে একই শিক্ষাবর্ষের দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান শাখায় মোট শিক্ষার্থী ছিল ২৭৬ জন। এর মধ্যে মাত্র ৯ জন ৮০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিত ছিল। ৭০ শতাংশের বেশি ক্লাসে উপস্থিত ছিল ২৬ জন। অর্ধেক ক্লাসেও হাজির হয়নি ৯৭ জন শিক্ষার্থী। এদের সবাই ছাত্র।

  • খুদে বার্তা চালুসহ ৫ সুপারিশ

স্কুলে শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকলে তা অভিভাবককে জানাতে এসএমএস পদ্ধতি চালু করার সুপারিশ করা হয়েছে সিএমপির এই জরিপে। পাশাপাশি সুপারিশ করা হয়েছে, নবম, দশম ও একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণির মোট ক্লাসের ন্যূনতম ৭০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না রাখা; যেসব শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার যৌক্তিক কারণে ৭০ শতাংশের নিচে থাকবে তাদের কারণ বিবেচনার জন্য শিক্ষা বোর্ডের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা রাখা; ধারাবাহিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও শ্রেণিকক্ষে ৭০ শতাংশ উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা।

  • পাশের দেশে যা চিত্র

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির গুরুত্ব তুলে ধরতে সিএমপি জরিপে পার্শবর্তী দেশ ভারতের চিত্র তুলে ধরেছে। জরিপে বলা হয়েছে, পার্শবর্তী দেশ ভারতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সেখানে কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ শ্রেণিতে উপস্থিতি না থাকলে কোনো শিক্ষার্থীকে বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি পাওয়া যায় না।

তবে কোনো শিক্ষার্থীর উপস্থিতি যদি ৭৫ শতাংশের কম হয় তবে আঞ্চলিক বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী আবেদন করলে বোর্ড কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে ওই শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে। কিছু কিছু প্রদেশে স্কুলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থী উপস্থিত না হলে সেই তথ্য তাৎক্ষণিক অভিবাবককে জানিয়ে দেয়। এতে করে ক্লাস চলাকালে শিক্ষার্থীরা অন্য কোনো স্থানে সময় কাটানোর সুযোগ থাকে না।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৮ দফা দাবিতে নতুন কর্মসূচি সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোটের

রাজধানীতে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত ২

সাবেক মন্ত্রীর আক্রোশের শিকার মাসুদ বিভাগীয় তদন্তে নির্দোষ

তথ্যগত বিভ্রান্তির কারণে সংবাদটি প্রত্যাহার করা হয়েছে

উন্নত চিকিৎসার অভাবে পা হারাতে পারেন সাকিব

লেবাননের প্রাণকেন্দ্রে ইসরায়েলের হামলা

সন্ত্রাস চাঁদাবাজি দখলদারির বিরুদ্ধে বিএনপির বিক্ষোভ

সকাল ৯টার মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা

নিজ গাড়িচাপায় প্রাণ হারালেন ট্রাকচালক

৮ দফা দাবিতে নতুন কর্মসূচি সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোটের

১০

‘সব আসনে এককভাবে প্রার্থী দেবে গণঅধিকার পরিষদ’

১১

ঢাবির আওয়ামীপন্থি সিন্ডিকেট সদস্যদের পদত্যাগ দাবি

১২

গণঅভ্যুত্থানের বীরত্বগাথা জাতিসংঘে তুলে ধরবেন ড. ইউনূস

১৩

মিরপুরে ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের বিক্ষোভ

১৪

প্রকাশ পেল ইকরাম কবীরের ‘খুদে গল্পের বই’

১৫

সৈনিক থেকে শিল্পপতি হাবিবুর

১৬

‘নবীর দেখানো পথে রাষ্ট্র উপহার দিতে চায় জামায়াত’

১৭

টাঙ্গাইলে বাস-অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত ২

১৮

১৬ বছর পর সাতক্ষীরায় জামায়াতের রুকন সম্মেলন

১৯

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

২০
X