রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভবনে শোভা পাচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র! অথচ বাসাবাড়ি, কর্মক্ষেত্র বা শিল্পকারখানায় অগ্নিদুর্ঘটনা এড়াতে দরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও সচেতনতা। আর এই সচেতনতা যদি অচেতনতা কিংবা লোক দেখানো হয়ে থাকে তাহলে তো কথা নেই।
চট্টগ্রাম আদালতে দেখা গেছে, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলো সাধারণত জরুরি পরিস্থিতিতে ছোট আকারের আগুন নেভাতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে বেশ কার্যকরী। তবে বড় আকারে আগুন ছড়িয়ে পড়লে এসব যন্ত্র খুব একটা কাজে আসে না। ছোট আকারের আগুন নেভাতে আদালত ভবনের দেওয়ালে স্থাপিত রয়েছে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র। যদিও এর সবগুলোই মেয়াদোত্তীর্ণ। কোনো কোনো অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের গায়ে লাগানো উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের লেভেল ছেঁড়া। সাধারণ মানুষের ভাষ্য, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভবন। এখানে হাজার হাজার মামলার নথি রয়েছে। আগুন লেগে যদি নথি পুড়ে যায় তাহলে সবার কপালও পুড়বে। এমন গুরুত্বপূর্ণ ভবনে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বসানোর ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই সজাগ ও সচেতন থাকা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
আইনি সহযোগিতা নিতে চট্টগ্রাম আদালতে আসা সাকি আল ফাহাদ নামে একজন কালবেলাকে বলেন, অগ্নিদুর্ঘটনা থেকে নিরাপদ থাকতে ফায়ার এক্সটিংগুইশার বা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের সঠিক ব্যবহার জানা ও বিষয়টি ভালো করে বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোয় এ বিষয়ের গুরুত্ব আবার সামনে এসেছে। গুরুত্বপূর্ণ ভবন ছাড়াও বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত, সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি জায়গাতে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র থাকা বাঞ্ছনীয়।
ছোট পরিসরের আগুন নেভাতে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এখন ভবন তৈরি করার সময় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বসানোর জন্য নির্দিষ্ট স্থান নকশার মধ্যে দেখাতে হয়। যারা এই যন্ত্রগুলো বসিয়েছেন বা দেওয়ালে স্থাপিত করেছেন সেগুলোর মেয়াদের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। মানুষকে দেখানোর জন্য দেওয়ালে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র স্থাপিত থাকলো আর তার মেয়াদ কখন যে শেষ হয়ে গিয়েছে তার খবর থাকলো না সেই কার্যক্রমের কোনো দরকার নেই। এতে উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকতে পারে। আদালতের ক্ষেত্রেও একই পরামর্শ। লোক দেখানো অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র স্থাপিত না করে সেগুলোর মেয়াদের কি অবস্থা সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
নিশিতা চেটার্যী কালবেলাকে বলেন, আগুনের ধরন অনুযায়ী উপযুক্ত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নির্বাচন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলো বের হওয়ার রাস্তা বা বিপদ ঘটার সম্ভাবনা আছে এরকম জায়গার কাছাকাছি রাখা উচিত। তবে এগুলো ব্যবহারের আগে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে আগে বের হওয়ার একটি নিরাপদ পথ রয়েছে কি না তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ২৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম আদালতে ক্লার্ক অ্যাসোসিয়েশন অফিসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওখানে ৬০ বছর আগের নথিপত্র ছিল। সব ইতিহাস ছিল। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ হাজার হাজার কাগজও সেখানে ছিল। আগুনে নথি, ব্যাংকের স্টেটমেন্ট, ডিপিএসের কাগজপত্র, সমিতির সদস্যদের হিসাবের বই সব পুড়ে গেছে।
২০১৭ সালের ৫ জুন নতুন আদালত ভবনের দ্বিতীয় তলার পূর্বপাশে মহানগর আদালতের মালখানায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। মালখানায় আলামত হিসেবে রাখা মোবিল ও অকটেনের ছোট কোটা থেকে আগুনের সূত্রপাত শুরু হয়। এসময় পুলিশ ও কর্মচারীরা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ব্যবহার করে আগুন নিভিয়ে ফেলে।
আদালত সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম আদালত ভবনে আনুমানিক ২০০ বেশি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বসানো আছে। প্রতিটি কক্ষের পাশে দেওয়ালে এই অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলো বসানো হয়েছে। চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এর কক্ষ থেকে শুরু করে মহানগর দায়রা জজ, জেলা দায়রা জজ, কোর্ট প্রসিকিউশন কক্ষ থেকে শুরু করে সবগুলো কক্ষের দেওয়ালে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বসানো আছে। যা আদালতে আগুন লাগলে তা নেভাতে সহায়ক হবে।
জেলা আইনজীবী মীর শফিকুল কবীর বিজন কালবেলাকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনা এড়াতে আদালত ভবনে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বসানো হয়েছে। গত বছরের শেষের দিকে আদালতে ক্লার্ক অ্যাসোসিয়েশন অফিসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। তখন অনেক নথি পুড়ে যায়। আগুন লাগার কোনো দিন, ক্ষণ, সময় থাকে না। যে কোনো মুহূর্তে আগুন লাগতে পারে। যেহেতু আদালত ভবন রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভবন, এই ভবনের দেওয়ালে স্থাপিত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলোর মেয়াদ আছে কি নেই সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষ সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, মূলত পাঁচ ধরনের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রয়েছে। প্রতিটি যন্ত্রই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের আগুন নেভানোর জন্য তৈরি। কাগজ, কাঠ, কাপড়, দাহ্য তরল ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের মতো বিভিন্ন উপকরণের আগুন নেভানোর জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট যন্ত্র; যেগুলো ভিন্ন ভিন্ন রঙ বা লেবেলে চিহ্নিত করা থাকে।
পানি, পানি থেকে সৃষ্ট কুয়াশা বা পানির স্প্রের অগ্নিনির্বাপক (লাল লেবেল) : কার্বন-ভিত্তিক কঠিন দাহ্য পদার্থ যেমন, কাগজ, কাঠ বা টেক্সটাইলের মত ক্লাস এ শ্রেণিভুক্ত আগুন নেভানোর জন্য এই নির্বাপক যন্ত্রগুলো বেশ উপযোগী। এগুলো পানি দিয়ে দাহ্য উপকরণকে ভিজিয়ে ঠান্ডা করার মাধ্যমে আগুন নিভিয়ে থাকে। তবে এটি তেল, ধাতু, তরল বা বৈদ্যুতিক উৎস থেকে সৃষ্ট আগুন নেভানোর উপযোগী নয়।
ফোম অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র (ক্রিম লেবেল) : এই ধরনের নির্বাপক যন্ত্রগুলো কঠিন পদার্থ এবং জ্বলন্ত তরল যেমন, পেট্রোল, পেইন্ট বা টারপেনটাইন থেকে সৃষ্ট এ এবং বি শ্রেণিভুক্ত আগুন নেভাতে কার্যকর। নিরাপদ দূরত্বে থেকে এগুলো কিছু বৈদ্যুতিক আগুন নিয়ন্ত্রণেও ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে ওই ধরনের বৈদ্যুতিক আগুনের জন্যে এটি উপযোগী কিনা সেটি আগে থেকে পরীক্ষিত হতে হবে।
ড্রাই পাউডার অগ্নিনির্বাপক (নীল লেবেল) : এই অগ্নিনির্বাপকগুলো কঠিন, তরল এবং গ্যাস থেকে সৃষ্টি হওয়া এ, বি ও সি ক্লাস আগুনের জন্য উপযুক্ত বহুমুখী ইউনিট। অপরদিকে ক্লাস ডি বা ধাতব আগুনের জন্যেও বিশেষ ধরনের পাউডার ভিত্তিক নির্বাপক যন্ত্র পাওয়া যায়। এগুলো আগুনের ওপর ফোমের মতো একটি আবরণ তৈরি করে আগুন নিভিয়ে দেয়।
কার্বন-ডাই অক্সাইড অগ্নিনির্বাপক (কালো লেবেল) : এটি দাহ্য তরল এবং বৈদ্যুতিক আগুনের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। এটি অক্সিজেনকে সরিয়ে দেয়, যার ফলে আগুন জ্বলতে পারে না। যেহেতু এগুলো ক্ষতিকর নয় এবং ব্যবহারের পর কোনো অবশিষ্টাংশ তৈরি করে না, তাই বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের আশেপাশে ব্যবহারের জন্য এগুলো বেশ উপযোগী। এগুলো রান্নার তেল এবং চর্বি দ্বারা সৃষ্ট এফ শ্রেণিভুক্ত আগুনের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। এই অগ্নিনির্বাপকগুলো আগুনকে ঠান্ডা করে এবং পুনরায় জ্বলে ঠেকায়। এগুলো কঠিন এবং তরল উভয় ধরনের দাহ্য পদার্থের ক্ষেত্রেও কার্যকর।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক কালবেলাকে বলেন, ভবনের দেওয়ালে স্থাপিত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলো ছোট আগুন নেভাতে কার্যকরী। সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে এই যন্ত্রগুলো বসানো থাকে। তাছাড়া বাসাবাড়িতে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও। নিজেদের নিরাপত্তার কারণে বসানো যন্ত্রগুলোর দিকে তাদেরই খেয়াল রাখতে হবে। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলো মেয়াদ আছে কী নেই।
চট্টগ্রাম আদালত ভবনের দেওয়ালে স্থাপিত মেয়াদোত্তীর্ণ অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের বিপরীতে আপনাদের পদক্ষেপ কী জানতে চাইলে আবদুর রাজ্জাক বলেন, চট্টগ্রাম আদালত ভবনতো গণপূর্ত দেখাশোনা করে। আমাদের সেখানে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে পরামর্শ চাইলে আমরা পরামর্শ দিই। নিরাপত্তার খাতিরে এই অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলোর মেয়াদ আছে কি নেই সে বিষয়ে অবশ্যই সজাগ ও সচেতন থাকা উচিত। আমাদের সচেতনতার প্রোগ্রাম প্রতি সপ্তাহে চলমান রয়েছে।
মন্তব্য করুন