নূর হোসেন মামুন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৫, ০৭:৪২ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

ব্যস্ততা বাড়লেও মুখে হাসি নেই চট্টগ্রামের জুতার কারিগরদের

ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন জুতার কারিগররা। ছবি : সংগৃহীত
ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন জুতার কারিগররা। ছবি : সংগৃহীত

দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আর উচ্চতা মিলিয়ে একই আকারের একটি ছোট্ট কক্ষ। কক্ষটিতে আবার কাঠের ছাদ বানিয়ে সেটিকে করা হয়েছে দ্বিতল। সেখানে আট থেকে ১০ শ্রমিক কাজ করে যাচ্ছেন একটানা। দম ফেলার ফুরসতও নেই। ঈদ সামনে রেখে এমনই ব্যস্ততা পাদুকাশিল্পীদের। ছোট-বড় কারখানাগুলোতে দিন-রাত সমানে চলছে কাজ। চট্টগ্রাম নগরের পূর্ব ও পশ্চিম মাদারবাড়ি, কদমতলী, শেরশাহ কলোনি এলাকায় গেলে দেখা মিলবে এমন চিত্রের।

বছরের এ সময়টাতে কিছুটা ব্যস্ত সময় পার করলেও বছরজুড়ে তেমন ব্যস্ততা নেই বললেই চলে। এ সময় কাজের চাপ বাড়লেও হাসি নেই পাদুকাশিল্পীদের মুখে। জুতা বানানোর আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি এবং যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মজুরি না বাড়ায় অনেকটা নিভতে বসেছে এ শিল্পটি। তাই এমন দুর্দিনে বেঁচে থাকাটাই যেন তাদের জন্য যুদ্ধ।

জুতা কারখানার মালিকরা জানান, ঈদ সামনে রেখে ব্যাপক জুতার চাহিদা থাকে। তাই অন্য সময়ের চেয়ে এ সময় কারিগরদের মজুরিও বেশি দেওয়া হয়। অন্য সময় যেখানে একজোড়া স্যান্ডেলের জন্য ২০ থেকে ৩০ টাকা এবং একজোড়া জুতার জন্য ৪৫ থেকে ৫০ টাকা দেওয়া হয়, সেখানে এখন তাদের দেওয়া হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা এবং ৭০ থেকে ৮০ টাকা করে। জুতা তৈরির কাঁচামাল ফোম, রাবার, স্টিকার, আঠা- সব উপকরণ আসে চীন থেকে। এসব জিনিসের দামও বেড়েছে।

চট্টগ্রাম ক্ষুদ্র পাদুকা মালিক সমিতির তথ্য অনুসারে, পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রামের মাদারবাড়ি এলাকায় গড়ে ওঠে হাতে তৈরি জুতার কারখানা। ২০১২ সালের আগ পর্যন্ত প্রায় ৩৫০টি কারখানা গড়ে উঠলেও করোনার কারণে ধস নামে এ ব্যবসায়। এ ছাড়া চায়না জুতার বাজার সয়লাব হয়ে যাওয়ায় অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে ২৫০টিরও কম কারখানা রয়েছে পূর্ব ও পশ্চিম মাদারবাড়ি এলাকায়।

কিশোরগঞ্জ থেকে ১৯৯৫ সালে বাবার সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরে আসেন সম্রাট সুজ নামের কারখানার মালিক মো. মেহরাজ। বাবার হাত ধরে কাজ শুরু করেন জুতা তৈরির কারখানায়। একযুগেরও বেশি সময় পর ২০১০ সালে নিজেই দেন কারখানা। শুরুতে দুজন শ্রমিক নিয়ে কারখানা শুরু করলেও এখন তার কারখানায় ১০ জনেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন।

মেহরাজ বলেন, ‘আগে একসময় ব্যবসা ছিল। সারা বছরই জুতার চাহিদা থাকত। এখন আর তেমন চাহিদা নেই। ১০ বছর আগেও এমন সময় ঈদের আগে ব্যবসায়ীরা এসে জুতা নিতে লাইন ধরত। এখন সে দিন আর নেই। ঈদের আগে সারা মাসে সাড়ে তিনশ ডজন জুতা বানানোর টার্গেট নিয়েছি। মানভেদে প্রতি ডজন জুতা ৩ থেকে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি করব।’

পূর্ব মাদারবাড়ির হাজী নছুমালুম লেইনের স্টার ব্র্যান্ড ফুটওয়্যারের পরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন বলেন, ‘আগের চেয়ে এখন অনেক প্রতিষ্ঠান কমে গেছে। পণ্যগুলোও কম চলছে। আগে ভৈরব থেকে চট্টগ্রামে এসে কাজ করতেন শ্রমিকরা। কিন্তু এখন তারা সেখানে ফ্যাক্টরি গড়েছেন। প্রায় কয়েকশ শ্রমিক-উদ্যোক্তা ভৈরব চলে গেছেন।’

তিনি বলেন, আগে কাঁচামাল ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে সংগ্রহ করতে হতো। কিন্তু এখন ভৈরবে বসেই পণ্যের সব কাঁচামাল সংগ্রহ করা যাচ্ছে। জুতা তৈরির পর ব্যবসায়ীরা সেখান থেকে এসে সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে সেখানে বসে এখন হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা তারা অনায়াসেই করতে পারছেন। ওখানে চীন থেকে মাল আনার ইমপোর্টার আছে, শ্রমিক আছে, সব সুবিধা হয়েছে। মূল কথা, বলতে গেলে চট্টগ্রামের বাজারটা ভৈরবে সৃষ্টি হয়েছে।

জেরিন সুজের মালিক কবির হোসেন বলেন, ‘চায়না জুতায় বাজার সয়লাবের কারণে আমরা হাতে তৈরি করা দেশি উৎপাদনকারী এমনিতেই ব্যাপক মন্দায় ছিলাম। তারপর করোনা আসার কারণে লকডাউনে কারখানা বন্ধ, দোকান ভাড়া, কারিগরের মাসিক বেতন, অন্যদিকে বকেয়া টাকা আটকে পড়া এবং জুতার অর্ডার ব্যাপক কমে যাওয়ায় আর টিকে থাকতে পারছিলাম না ব্যবসায়। তাই প্রথম লকডাউনের পরই কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই। এরপর আর ঘুরে উঠতে পারিনি। সেই সংকট এখনো পিছু ছাড়েনি।’

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের (এসএমইএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে এখন এআই বেইজড কাজ হচ্ছে। সুতরাং আমাদের উদ্যোক্তাদের সময়ের সঙ্গে নিজেদের কাজের পরিবর্তন আনতে হবে। নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। পণ্যের ডিজাইন ও মানে তার ছাপ থাকতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে সে রকম দক্ষ শ্রমিক। পাদুকা শিল্পের উন্নয়নে আমরা সূচনালগ্ন থেকেই তাদের সঙ্গে আছি। সেমিনার, ওয়ার্কশপ, সহায়তাসহ সবভাবে আমরা তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছি।

তিনি বলেন, আমরা চাই- এই শিল্প যেন টিকে থাকে। চট্টগ্রামের উদ্যোক্তাদের সংকট দূর করতে এরই মধ্যে ২০০ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়েছে। যাদের পরিবেশ ও ভালো মানের যন্ত্রপাতি নেই, তারাও যেন কাজ করতে পারেন, এজন্য আমরা কম-বেশি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘কমন ফ্যাসিলেটিস সেন্টার (সিএফসি)’ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। যেখানে বসে উদ্যোক্তারা বিনা খরচে তাদের মালপত্র উৎপাদন করতে পারবেন। আগামী বছরের মধ্যেই এই সিএফসি বসাতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও হয়েছে।

চট্টগ্রাম ক্ষুদ্র পাদুকা শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মনজুর খান বলেন, উদ্যোক্তাদের কেউ-ই প্রণোদনার ঋণ পাননি। অনেকেই পুঁজির সংকটে ব্যবসায় ফিরতে পারছেন না। যেসব কারখানা আবার নতুন করে ব্যবসা করছে, তারাও সংকটে রয়েছে। সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছে, বিদেশি জুতার আমদানিতে যাতে পর্যাপ্ত শুল্ক আরোপ করা হয়। বিদেশ থেকে আমাদের কাঁচামাল আমদানিতে ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে যেন ১০ শতাংশ করা হয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাতে জুতা তৈরি করার পরিবর্তে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে কম খরচে বেশি উৎপাদন করতে পারে, সেজন্য অত্যাধুনিক মেশিনারিজ স্থাপন করা দরকার।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জাফলংয়ে রাতে দুগ্রুপের সংঘর্ষ, আহত ২০

মসজিদে কিশোরীকে দুই দফা ধর্ষণের অভিযোগ, ইমাম আটক

লক্ষ্মীপুরে জেলেদের হামলায় পুলিশসহ আহত ৪, আটক ১৩

পিআইসিইউতে মাগুরার সেই শিশুটি

ইউনাইটেডের সাথে ড্র করে আর্সেনালের শিরোপা স্বপ্নে ধাক্কা

ধর্ষণের প্রতিবাদ ও বিচার দাবিতে যবিপ্রবিতে বিক্ষোভ মিছিল

সাবেক দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামের সহযোগী শেখ সাইদ গ্রেপ্তার

ভিনি-এমবাপ্পের গোলে রিয়ালের সহজ জয়

ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

সারা দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদে চবিতে মশাল মিছিল

১০

ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবিতে বাকৃবিতে বিক্ষোভ

১১

ওয়ানডে ছাড়ছেন না রোহিত শর্মা, নিজেই দিলেন ঘোষণা

১২

ককটেল ফাটিয়ে সোনার দোকানে ডাকাতি, মালিক নিহত

১৩

নোমানের স্মরণসভায় বিএনপির হাতাহাতি

১৪

তিন মাসে ৩ দেশ সফরে যাবেন ড. ইউনূস

১৫

দেশে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০ মাসে সর্বনিম্ন

১৬

জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে আ.লীগ নিষিদ্ধ চায় এবি পার্টি 

১৭

ধর্ষকের ফাঁসির দাবিতে কবি নজরুল কলেজে প্রতিবাদ সমাবেশ

১৮

আজকের ‘ধর্ষণবিরোধী মঞ্চ’র ৫ দফা দাবি

১৯

গ্রাম্য সালিশে দুগ্রুপের সংঘর্ষ, বিএনপি নেতাসহ আহত ২০

২০
X