শুল্কমুক্ত সুবিধায় ২৪টি গাড়ি আমদানি করেছিলেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এসব গাড়িসহ মোট ৪৪টি গাড়ি আটকে দেয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে থাকা বিলাসবহুল গাড়িগুলো নিলামে তুলেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস।
আগামীকাল সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) হবে নিলাম কার্যক্রম। দুপুর ২টায় উন্মুক্ত করা হবে দরপত্র। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় এসব গাড়ি কিনতে দরপত্র জমা দিয়েছিলেন বিডাররা। শেষ পর্যন্ত এসব গাড়ির মালিক কারা হচ্ছেন, তা জানা যাবে আজ।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সহকারী কমিশনার মো. সাকিব হোসেন কালবেলাকে জানান, গাড়িগুলো নিলামে কিনতে আগ্রহীরা চট্টগ্রাম কাস্টমসের নির্ধারিত ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে অনলাইনে গতকাল রোববার পর্যন্ত দরপত্র দাখিল করেন। আজ সোমবার দুপুর ২টায় দরপত্র উন্মুক্ত করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২৭ জানুয়ারি সকাল ৯টা থেকে অনলাইনে দরপত্র দাখিল প্রক্রিয়া শুরু হয়। মাঝে গত ২ থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত গাড়িগুলো দেখার সুযোগ পান আগ্রহীরা। এরই মধ্যে নিলামযোগ্য অনেক গাড়ি কাস্টমসের অকশন শেডে আনা হয়েছে।
কাস্টমস সূত্র জানিয়েছে, নিলামযোগ্য ৪৪টি গাড়ির মধ্যে আছে জাপানের তৈরি ২৬টি ল্যান্ড ক্রুজার, পাঁচটি টয়োটা হ্যারিয়ার, দুটি টয়োটা র্যাভ ফোর, একটি টয়োটা এস্কোয়ার ও চীনের তৈরি ১০টি হেভি ডিউটি সিনো ডাম্পট্রাক।
গাড়িগুলোর মধ্যে ২৪টি নতুন ল্যান্ড ক্রুজার, যা শুল্কমুক্ত সুবিধায় আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্যরা এনেছিলেন। ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ির প্রতিটির সংরক্ষিত মূল্য ধরা হয়েছে ৯ কোটি ৬৭ লাখ ৩ হাজার ৮৯৯ টাকা। দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে থাকা বাকি দুটি ল্যান্ড ক্রুজারের মধ্যে একটির মূল্য ১ কোটি ৬২ লাখ ৭৩ হাজার ৮৪ টাকা এবং অন্যটি ১ কোটি ৩৭ লাখ ৯৬ হাজার ১২১ টাকা ধরা হয়েছে।
এ ছাড়া ২০২২ সালে তৈরি ২৪৮৭ সিসির একটি হ্যারিয়ার গাড়ি ৭৬ লাখ ১৪ হাজার ৬৭৩ টাকা, ২০২২ সালে তৈরি ১৯৮৬ সিসির হ্যারিয়ার আইচি ৮২ লাখ ৩ হাজার ৬৬৭, ২০২০ সালে তৈরি ১৯৮৬ সিসি গাড়ি ৬১ লাখ ৬১ হাজার ৩৪৯, ২০১৯ সালের ১৯৮৬ সিসি আরেকটি হ্যারিয়ার গাড়ি ৫৫ লাখ ৫১ হাজার ৪৮২ এবং ২০১৮ সালের ১৯৮৬ সিসি আরেকটি হ্যারিয়ার গাড়ির ৫৫ লাখ ৫১ হাজার ৭৮৭ টাকা মূল্য ধরা হয়েছে।
দুটি র্যাভ ফোরের মধ্যে ২০১৯ সালের মডেলের মূল্য ৫৪ লাখ ৫৪ হাজার ৬৪৪ টাকা এবং ২০২০ সালের গাড়িটির মূল্য ৫৬ লাখ ২২ হাজার ১০৭ টাকা ধরা হয়েছে। ২০১৯ সালের ১৯৮৬ সিসি টয়োটা এস্কোয়ারের দাম ৩০ লাখ ৩৮ হাজার ১৬৮ টাকা এবং চীনের তৈরি ১০টি হেভি ডিউটি সিনো ডাম্পট্রাকের ছয়টির প্রতিটি ৮৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯৩২ টাকা এবং বাকি চারটির প্রতিটি ৮৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮১ টাকা দাম ধরা হয়েছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কার শেড পরিদর্শন করে দেখা যায়, বিডার ছাড়াও ব্যক্তিপর্যায়ের অনেকে কার শেডের সামনে নিলামে তোলা গাড়িগুলো দেখতে ভিড় করেন। বন্দরের নিরাপত্তাকর্মীরা ক্যাটালগসহ তাদের প্রবেশ করান। এরপর আগ্রহীরা শত শত গাড়ির ভিড় থেকে গাড়ির ক্যাটালগ দেখে নিলামের গাড়িগুলো চিহ্নিত করে দেখেন।
মো. মাসুম নামে একজন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এবার তো একদম ফ্রেশ গাড়ি নিলামে উঠছে। এ ধরনের নিলাম বাংলাদেশে কখনো হয়নি। তাই বিডারদের আগ্রহ বেশি এই নতুন গাড়িগুলোতে। এরপরও আমি ব্যক্তিগতভাবে নিলামে বিড করার চেষ্টা করছি। বিডাররাও আমাকে সহযোগিতা করছেন। তবে বিডাররা বলছেন, গাড়ির মূল্য বেশি ধরা হয়েছে। আমি মনে করি, কাস্টমস দাম একটু বেশি রাখায় বিডিং বেশি হবে। চ্যালেঞ্জটা অনেক বেশি হবে।’
নিলামের সংরক্ষিত মূল্য নিয়ে বিডার নাছির উদ্দিন ছোটন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমি বিডে অংশগ্রহণ করি। এবারের নিলামে নতুন গাড়ি থাকায় আমাদের আগ্রহটা অনেক বেশি ছিল। কারণ এখানে প্রায়ই একদম আপডেট গাড়ি। ২৩-২৪ সালের গাড়ি হওয়ায় কাস্টমস অ্যাসেসমেন্ট করার সময় একবার ভ্যাট নেয়। বিডের পরে আবার আমাদের ভ্যাট দিতে হয়। কাস্টমস অ্যাসেসমেন্টে ভ্যাট ধরার কারণে গাড়ির ভ্যালুয়েশন বেড়ে যায়। এ উচ্চমূল্যের ওপর নিলামের স্থায়ী আদেশ অনুযায়ী নিলাম দর রাখতে হয় ৬০ শতাংশের ওপর। ৬০ শতাংশের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ১০ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়। তার মানে প্রায় ৮৫ শতাংশ দাম দিয়ে গাড়িটি নিলে আমাদের পক্ষে তা বিক্রি করা সম্ভব হয় না।’
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নিলাম ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. এয়াকুব চৌধুরী বলেন, ‘২৪টি এমপিওভুক্ত গাড়ি ও চায়না ডাম্পট্রাকগুলো নতুন। এর মধ্যে মনে হচ্ছে ডাম্পট্রাকগুলোর ভ্যালু বেশি ধরা হয়েছে। এমপিদের গাড়িগুলোর ভ্যালু ঠিক আছে। ঠিক থাকলে কি হবে, কাস্টমসে বিড করে ৬০ শতাংশ কভার করে ফার্স্ট (প্রথম) বিডে আমার মনে হয় না আগ্রহ তেমন থাকবে। আমরা যারা ৩০ থেকে ৪০ বছর ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, আমরা মনে হয় এ সাহস করব না। এমপিদের গাড়িগুলো বিক্রি করার মতো কোনো কাস্টমার আমাদের কাছে এখনো আসেনি। আগ্রহ আছে হ্যারিয়ার, র্যাভ ফোর ও টিএক্স গাড়িতে। এগুলো ভালো বিড হয়েছে বলে মনে হয়।’
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নিলাম শাখার সহকারী কমিশনার মো. সাকিব হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে সাবেক সংসদ সদস্যদের গাড়ি ছিল মোট ৩২টি। এবার ৩২টি গাড়ি নিলামে তোলার কথা। তবে সাতটি গাড়ি যারা এনেছেন, তাদের কারও ঠিকানায় ও কারও আনা গাড়ির চেসিস নম্বরে ভুল থাকায় আইনগতভাবে পিছিয়ে যায়। এ ছাড়া অন্য একটি গাড়ি শুল্কায়নের নির্ধারিত মূল্যে একজন সাবেক সংসদ সদস্য নিয়ে যান। তাই আমরা আশা করছি, সংরক্ষিত মূল্য বেশি ধরা হয়নি। বিডাররা আগ্রহ রাখবেন। যদি বেশি হতো, তাহলে শুল্কায়ন শাখার মূল্যে এ গাড়ি নিতো না।’
মন্তব্য করুন