টানা ১৫ বছর পর রেল অঙ্গনে এই প্রথম চট্টগ্রামের সিআরবিতে মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) শোডাউন বা শ্রমিক সমাবেশ করবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী রেলওয়ে শ্রমিক ও কর্মচারী দল। এ সমাবেশে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন শাখা কমিটির নেতৃবৃন্দরা ছাড়াও রেলওয়ের কেন্দ্রীয় নেতারাও উপস্থিত থাকবেন। এমন সমাবেশ ঘিরে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং নতুন আমেজ এসেছে শ্রমিকদলের নেতাকর্মীদের মাঝে।
বহু বছর পর এমন আয়োজন শুনে প্রতিটি শাখা থেকেও ব্যানার, ফেস্টুনে মিলিত হবেন নেতাকর্মীরা। এই সমাবেশে শ্রমিকদের ১৬টির মতো বিভিন্ন সুপারিশ ও ১০টার মতো দাবি তুলে ধরা হবে। এসব দাবি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্যও শীর্ষ কর্তাদেরও স্বারকলিপিও দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী রেলওয়ে শ্রমিক ও কর্মচারী দলের সাধারণ সম্পাদক এমআর মনজু কালবেলাকে বলেন, টানা ১৫ বছর কোনো মিটিং মিছিল করতে পারিনি। নানাভাবে বঞ্চিত হয়েছি । সরকার পতনের পর নতুন করে রেল অঙ্গনে বড় ধরনের সমাবেশ করছি। এতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটির নেতারা ছাড়াও কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত হবেন। ফলে দীর্ঘদিন পর নেতাকর্মীরাও উৎসাহ-উদ্দীপনা মিলিত হবে।
তিনি বলেন, এই সমাবেশ ছাড়াও নতুন করে বিভিন্ন দাবি ও সুপারিশও করা হচ্ছে। মানসম্মত আবাসন এবং রেল কলোনিতে বাসযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, স্বচ্ছতার মাধ্যমে নিয়োগ ও অবিলম্বে শূন্য পদসমূহ পূরণ করা, নিয়োগ বিধি ২০২০ সংশোধন ও কর্মচারীদের কিছু পদবী নামের পরিবর্তন করণ, রেলওয়ে কল্যাণ ট্রাস্ট পুনর্গঠন করে প্রত্যাশিত কল্যাণ সাধন নিশ্চিত করণ, অবসর পরবর্তীতে প্রদেয় ভাতা ৫০ হাজার টাকায় উন্নীত করাসহ ১০টা দাবি এবং আরও বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরা হবে।
জাতীয়তাবাদী শ্রমিকদল নেতা আবু বকর ছিদ্দিক বলেন, বহুবছর পর রেল অঙ্গনে সমাবেশ করতে যাচ্ছি। এই সমাবেশ ঘিরে নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার আমেজ তৈরি হয়েছে। এতে বিভিন্ন শাখা থেকে ব্যানার, ফেস্টুনসহ সব নেতাকর্মীরা সম্মিলিতভাবে শ্রমিক সমাবেশে উপস্থিত হবেন।
১৬টি সুপারিশের মধ্যে রয়েছে সার্বিক প্রেক্ষাপট বিচেনায় সুষ্ঠু রেল পরিচালনার স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ যে দাবিগুলো আছে তা হলো
১. দলীয় বিবেচনায় দীর্ঘদিন একই পদে/একই জায়গায় বিশেষ সুবিধা প্রাপ্ত কর্মচারী/কর্মকর্তাদের দ্রুত বদলির মাধ্যমে প্রসাশনকে দক্ষ, নিরপেক্ষ ও কার্যকর করা। চিহ্নিত দলবাজ, দুর্নীতিবাজ, ফ্যাসিস্টের সহযোগী সুবিধাভোগী কর্তাদের অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বে সরিয়ে নেওয়া।
২. ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে বৈষম্যবিহীন একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রত্যেককে স্ব-স্ব কাজের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে এবং বিগত সময়কার সব দুর্নীতি, অনিয়ম-অপচয়ের আইনানুগ ও দৃষ্টান্তমূলক প্রতিকার নিশ্চিত করা।
৩. সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের তথা ট্রেড ইউনিয়নের মতামত গ্রহণ করা এবং সবস্তরে নিয়মিত পাক্ষিক বৈঠক বা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে উদ্ভুত সমস্যাবলী সমাধানের কার্যকর উদ্দ্যোগ নিয়ে প্রত্যাশিত শিল্প সম্পর্ক নিশ্চিত করা।
৪. লোকোসেড ইয়ার্ড এবং কারখানাগুলোতে প্রর্যাপ্ত মানসম্মত মালামাল সরবরাহ, ওয়াকসপগুলোকে আধুনিকায়ন ও পূর্ণ ক্ষমতায় ব্যবহার করে রক্ষনাবেক্ষণের পাশাপশি কিছু পরিমাণ স্পেয়ার পার্টস তৈরির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের উদ্যোগ নেওয়া। প্রয়োজনে কারখানাসমূহে দুই শিফট চালু করা যেতে পারে।
৫. নিয়োগবিধি-২০২০ জরুরি ভিত্তিতে সংশোধনপূর্বক ৩/৪র্থ শ্রেণির অত্যাবশ্যকীয় কারিগরি শূন্যপদে পিএসসির পরিবর্তে নিজস্ব কমিটির মাধ্যমে অতি দ্রুত জনবল নিয়োগের ব্যবস্থা করা। ৪র্থ শ্রেণির পদে শিক্ষাগত যোগ্যতা দেশের অন্য প্রতিষ্ঠানের ন্যায় এসএসসির পরিবর্তে ৮ম শ্রেণি করা। অনুমোদিত নিয়োগবিধি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ। ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগবিধির কারণে কর্মচারীদের নিয়োগ পদোন্নতিতে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। নিয়োগবিধি সংশোধন না হওয়ায় কর্মচারীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে সম্প্রতি অনুষিত এককেন্দ্রিক সিদ্ধান্তের পরিবর্তে পূর্বের ন্যায় দুই জোনে আলাদা কমিটির মাধ্যমে বিভাগীয় প্রধানদের মাধ্যমে পদোন্নতি দ্রুততর করা।
৬. রেলের জন্য আত্মঘাতী ‘আউট সোর্সিং’ বন্ধ করে পূর্বের নিয়মে টিএলআর/অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগের মাধ্যমে দক্ষ শ্রমশক্তির প্রবাহ জারি রাখার ব্যবস্থা নেওয়া। রেলের অনলাইন টিকিট ব্যবস্থাপনা প্রাইভেটে (সহজ ডটকম) না দিয়ে রেলের টেলিকম বিভাগের অধীনে নিজ সফটওয়্যার ব্যবস্থা করা।
৭. ন্যায় সংগত অংশিদারত্বের ভিত্তিতে ‘রেলভূমি বিনিয়োগ’ করে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেওয়া। ন্যায্য অংশিদারীত্বের ভিত্তিতে রেলভূমি পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করে রেলের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করে দ্বিগুণ করা সম্ভব। এরইমধ্যে অন্যায্য অংশিদারত্ব অথবা টোকেন মূল্যের বিনিময়ে যেসব প্রতিষ্ঠানকে রেলভূমি ইজারা/বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সে সব অসম চুক্তি বাতিল অথবা সংশোধনের মাধ্যমে রেলের স্বার্থ রক্ষা করা হোক। এতে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে।
৮. অতি দ্রুততার সঙ্গে অন্তত ৩০টি মানসম্পন্ন লোকোমোটিভ, ২০০টি কোচ ও অন্যান্য রোলিং ষ্টক সংগ্রহ করা। বিশেষ প্রোগ্রামের মাধ্যমে মেরামতের অপেক্ষমাণ সব লোকোমোটিভ কোচ ও অন্যান্য রোলিং স্টক দ্রুত মেরামতের মাধ্যমে প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা।
৯. শ্রমিক কর্মচারীদের ১০ দফা দাবির ন্যায্যতা বিবেচনায় পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া। এজন্য সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনার ব্যবস্থা করাসহ ১৬ টি সুপারিশ রয়েছে।
অন্যদিকে ১০ টি দাবির মধ্যে রয়েছে-
১. সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২ মাসের মধ্যেই পেনশন প্রদান নিশ্চিতকরণ
২. রাজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে রেলভূমির যথাযথ সংরক্ষণ ও ব্যবহার নিশ্চিতকরণ
৩. রেলভূমি ইজারার ক্ষেত্রে কর্মচারী ও পোষ্যদের কোটা/অগ্রাধিকার দেওয়া।
৪. প্রাপ্য শ্রেণিতে পাস ব্যবহারের অধিকার নিশ্চিতকরণ
৫. ইস্যুকৃত পাশের আসন বরাদ্দ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সব ট্রেনে ‘কোটামুক্ত’ সুবিধা প্রদান এবং অব্যবহৃত প্রিভিলাইজ পাশের জন্য টিকেটের সমমূল্য কর্মচারীর অনুকূলে নগদায়ন করতে হবে
৬. রেজিস্টার্ড ইউনিয়নের এড ইনটেরিম কার্ড পাশকে পূর্বের ন্যায় সর্বোচ্চ শ্রেণীতে প্রদান করতে হবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়েতে দূর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, সীমাহীন বৈষম্য, অপচয় ও গোঁজামিলের কারণে একদিকে বাড়ছে লোকসান অন্যদিকে পুঞ্জিভূত বঞ্চনা ও অপ্রাপ্তির যন্ত্রণায় কর্মচারীদের মাঝে বিরাজ করছে অসন্তোষ, চরম ক্ষোভ, হতাশা। অবশেষে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যূত্থানে সরকারের পতনের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশে রেলওয়েকে গণমানুষের প্রত্যাশার সমান্তরালে উন্নীত করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
মন্তব্য করুন