বুধবার থেকে পরবর্তী গেল ২৪ ঘণ্টায় অর্থাৎ বৃহস্পতিবার বিকেল তিনটা পর্যন্ত বন্দর নগরী চট্টগ্রামে রেকর্ড করা হয়েছে ১৫৮.৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনবরত অতি ভারি বর্ষণের ফলে নড়বড়ে হয়ে পড়েছে পাহাড়। শক্ত মাটি ঘেমে হচ্ছে নরম, তা সড়ে গিয়ে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বড় দুর্ঘটনার। যদি তেমন কোন পরিস্থিতির জন্ম দেয় তবে তা হবে স্মরণকালের সব থেকে বড় ঘটনা। কিন্তু মৃত্যুর ঝুঁকি থাকলেও চট্টগ্রামের ২৬ পাহাড়ে বসবাস করা প্রায় ৬ হাজার ৫৫৮টি পরিবারকে সচেতন করা যায়নি এখনো। প্রতি বর্ষায় প্রাণ যায় কেউ না কারও, সেই আবারও পুরোনো ধারায় প্রাণঘাতি পাহাড়ের ঢালেই বসবাস করেন তারা। এবারও বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে সচেতনতা দেখা গেছে প্রশাসনের। প্রাণহানি ও ঝুঁকি এড়াতে খোলা হয়েছে ২৩৯টি আশ্রয়কেন্দ্র।
বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) পর্যন্ত সেখানে অবস্থান নিয়েছে প্রায় ১৭০০ মানুষ। বাকিদের উদ্ধারেও কাজ করছে জেলা প্রশাসন। করা হচ্ছে মাইকিং, বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাড়ানোর চেষ্টা করছেন সচেতনতাও।
জানা যায়, চট্টগ্রামে বৃষ্টি কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলেই তৈরি হয় পাহাড়ধসের শঙ্কা। শুরু হয় ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাসকারীদের অন্যত্র সরানোর কাজ। পরিচালিত হয় উচ্ছেদ অভিযান। কিন্তু দুর্যোগ শেষ হলেই সবকিছু আবারও স্বাভাবিক হয়ে যায়। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোতেই ফের শুরু হয় বসবাস। সরকারি-বেসরকারি মালিকানাধীন পাহাড়গুলোতে অবৈধভাবে দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রতিটি সভায় সেবা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা বিভিন্ন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিলেও কার্যত তা বাস্তবায়ন করা হয় না। ফলে দিনের পর দিন ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে পাকাপোক্ত হয়ে বাস করেন অবৈধ বাসিন্দারা।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরে সরকারি-বেসরকারি মালিকানাধীন ঝুঁকিপূর্ণ মোট ২৬টি পাহাড় আছে। এসব পাহাড়ে বাস করে ৬ হাজার ৫৫৮টি পরিবার। ২৬ পাহাড়ের মধ্যে ১৬টি সরকারি সংস্থার ও ১০টি ব্যক্তিমালিকানাধীন। পাহাড়গুলো তদারকিতে আছে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। ২০০৭ সালের জুন মাসে গঠিত এ কমিটি গত ১৭ বছরে ২৭টি সভা করেছে। সর্বশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয় গত বছরের ৮ আগস্ট। প্রতিটি সভায় ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে অবৈধ বসবাসকারীদের উচ্ছেদ, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও ওয়াসার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত আলোর মুখ দেখেনি। তাছাড়া সেবা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে বিষয়টা নিয়ে অবহেলা করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ তোফায়েল ইসলাম বলেন, নগরীর ২৬টি পাহাড়ের মধ্যে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা বা বিভাগের মালিকানাধীন ১৬টি এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি। শুধু চট্টগ্রাম রেলওয়ের জায়গায় অবৈধভাবে বসবাস করা পরিবারগুলোতেই রয়েছে পাঁচ হাজার ৩০০ অবৈধ বৈদ্যুতিক লাইন। কর্তৃপক্ষ যদি কাউকে বন্দোবস্ত না দেয়, তাহলে সেখানকার বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করা হবে। আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব অসহায়দের সহায়তা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিছুদিন আগেও চট্টগ্রাম বিভাগের সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষকে আশ্রায়ণ প্রকল্পের ঘর দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) রাকিব হাসান বলেন, ২৬টি পাহাড়ে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত এক বছরে অনেক খাসজমি উদ্ধার করা হয়েছে। যেখানে আগে অবৈধ বসবাস ছিল। যারা ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন তাদের নিরাপদে ফেরাতে খোলা হয়েছে ২৩৯টি আশ্রয় কেন্দ্র। বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) পর্যন্ত প্রায় ১৭০০ জনের মত মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে এসেছেন। এদের মধ্যে ৬১৭ জন পুরুষ, ৬২০ জন নারী ও ৪৬৩ জন শিশু। এছাড়া আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়াদের মধ্যে রয়েছেন ২৫ জন প্রতিবন্ধীও।
তিনি আরও বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় মোট ৫০ মেট্রিক টন চাল ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ফটিকছড়ি উপজেলায় ২০ মেট্রিক টন, মিরসরাই উপজেলায় ২০ মেট্রিক টন, সীতাকুÐ উপজেলায় ১০ টন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামের সকল উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে গঠন করা হয়েছে ১৩৭টি মেডিকেল টিম। গঠন করা সবগুলো টিমই নিরলস কাজ করছেন।
ঝুঁকি জেনেও পাহাড়ে ঠাঁই : প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ধসে মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও বন্ধ হচ্ছে না পাহাড়ে বসবাস। গত ১৩ বছরে পাহাড়ধসে প্রাণ হারিয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ। এরপরও ঝুঁকি নিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ বসবাস করছেন পাহাড়ে। তবে এসব মানুষের বেশিরভাগই নিম্ন আয়ের।
বাটালি হিল পাহাড়ে বসবাসকারী জোছনা বেগম বলেন, মাথা গোঁজার মতো জায়গা নেই, তাই এখানে থাকি। সরকারের পক্ষ থেকে পুনর্বাসন করা হলে আমরা সেখানে চলে যাবো। কৈবল্যধাম হাউজিং এস্টেট সংলগ্ন পাহাড়ে বসবাস করা রিকশাচালক কবির আহমেদ বলেন, এই পাহাড় ফেলে যাওয়ার কোন জায়গা নেই। কোথায় যাবো, যাওয়ার মত সে রকম কোন জায়গাই নেই। তাই বাধ্য হয়েই এখানে দীর্ঘ বছর ধরে থাকতে হয়। আমরা আশা করি সরকার আমাদের প্রতি সুদৃষ্টি দিবে। আমরা এভাবে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করতে চাই না। আমরাও ভালো পরিবেশে নিরাপদে বসবাস করতে চাই। কিন্তু তার জন্য যেমন টাকা দরকার তেমনি ভাড়া চালানোর সমামর্থও দরকার। যার কোনোটাই আমাদের নেই।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে এক দিনেই পাহাড় ধসে নারী-শিশুসহ মারা যান ১২৭ জন। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট লালখান বাজারের মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড়ধসে মৃত্যু হয় চার পরিবারের ১২ জনের। ২০১১ সালের ১ জুলাই টাইগারপাস এলাকার বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে মারা যান ১৭ জন। ২০১২ সালের ২৬ ও ২৭ জুন, দুদিনে মারা যান ২৪ জন। ২০১৩ সালে মতিঝর্ণায় দেয়াল ধসে মারা যান দুজন।
২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার আমিন কলোনিতে মারা যান তিনজন। একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর মাঝিরঘোনা এলাকায় মা-মেয়ের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালের ১২ ও ১৩ জুন রাঙামাটিসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাঁচ জেলায় পাহাড়ধসে প্রাণহানি ঘটে ১৫৮ জনের। ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর নগরের আকবরশাহ থানার ফিরোজশাহ কলোনিতে মারা যান চারজন। ২০১৯ সালে কুসুমবাগ এলাকায় মৃত্যু হয় এক শিশুর। ২০২২ সালের ১৮ জুন মারা যান চারজন।
কোন পাহাড়ে কত পরিবার : ঝুঁকি নিয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ বসবাস করেন আকবরশাহ থানার ফয়’স লেক এলাকার ১, ২ ও ৩ নম্বর ঝিল সংলগ্ন পাহাড়ে। এখানে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা প্রায় চার হাজার ৪৭৬টি।
এছাড়া মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল পাহাড়ে ৪৩১টি, কৈবল্যধাম হাউজিং এস্টেট সংলগ্ন পাহাড়ে ১৪৬টি, পলিটেকনিক হল্ট স্টেশন সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে ১২টি, ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ফৌজি ফ্লাওয়ার মিল সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে পাঁচটি, ষোলশহর রেলস্টেশন সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে ৭৪টি, পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৬টি, লেকসিটি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন বিজয় নগর পাহাড়ে ২৮৮টি, আমিন জুট মিল কলোনি সংলগ্ন ট্যাঙ্কির পাহাড়ে ৬৫টি, উত্তর পাহাড়তলী মৌজার ১৫০ দাগের খাস খতিয়ানভুক্ত পাহাড়ে (জয়ন্তিকা আবাসিক সংলগ্ন) ২৮টি, বিএস ২১২ ও ২১৩ দাগের পাহাড়ে (মুরগি ফার্ম হয়ে গার্ডেন ভিউ সোসাইটি সংলগ্ন) ১২টি, আকবরশাহ বেলতলী পাহাড়ে ৮৯টি এবং পলিটেকনিক কলেজ সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩টি পরিবার বসবাস করছে।
এ ছাড়াও লালখানবাজার জামেয়াতুল উলুম মাদরাসা সংলগ্ন পাহাড়ে ৩২৩টি, হারুন খান সাহেবের পাহাড়ে ১৪৪টি, নাছিয়াঘোনা এলাকায় ১২টি, চিড়িয়াখানার পেছনের পাহাড়ে ২৮টি, মধুশাহ পাহাড়ে ২৯টি, জালালাবাদ সংলগ্ন পাহাড়ে পাঁচটি, নাগিন পাহাড়ে ২৫টি, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট সংলগ্ন মীর মোহাম্মদ হাসানের পাহাড়ে ৩৮টি, এমআর সিদ্দিকীর পাহাড়ে ৪২টি, মিয়ার পাহাড়ে ৪৯টি এবং ভেড়া ফকিরের পাহাড়ে (রৌফাবাদ, অক্সিজেন) ১১টি পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে।
মন্তব্য করুন