‘পুনর্বাসন ছাড়া মিরনজিল্লাহ হরিজন পল্লী উচ্ছেদ করা যাবে না’ কয়েক হাজার অসহায় মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত এই স্লোগানে প্রকম্পিত হয়েছে নগরীর পুরোনো ঢাকা। সমস্বরে সবাই বলেছেন, বংশালের এই পল্লী ঘিরে ৪০০ বছরের পুরোনো বসতি। যেখানে কয়েক হাজার মানুষ গাদাগাদি করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। চলমান এই অবস্থার মধ্যেও বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা থেকে উচ্ছেদ হলে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব, এমন প্রশ্ন সবার। মেয়রের এই সিদ্ধান্ত চরম মানবাধিকার লঙ্খনের সামিল বলেও মনে করেন হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষ।
বৃহস্পতিবার (৬ জুন) ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মিরনজিল্লা হরিজন পল্লী উচ্ছেদের প্রতিবাদে বংশালের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের আগা সাদেক সড়কে কলোনির সামনে ‘বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদ’ মানববন্ধনের আয়োজন করে।
এতে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও ঢাকা মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির নেতারা অংশ নেন। স্থানীয় লোকজনও উপস্থিত হয়ে সংহতি জানান।
জানা গেছে, এই পল্লীতে প্রায় সাত শতাধিক পরিবারের বসতি। এরমধ্য থেকে সিটি করপোরেশনে কর্মরত ৬৯ ছাড়া অন্যদের উচ্ছেদ করে এখানে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন।
হরিজন নেতারা বলছেন, ৪০০ বছর আগে এই অঞ্চলে তাদের পরিচ্ছন্ন কাজের জন্য ভারত থেকে আনা হয়। তাদের সবার বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা এই কলোনী। সিটি কর্পোরেশনে কর্মরত পরিচ্ছন্ন কর্মীদের অনেকেই মারা গেছেন, চাকরিচ্যুত হয়েছেন। তাই করপোরেশনে নিয়মিত চাকরিজীবীর সংখ্যা কমলেও সবার জীবন জীবিকার মূল উৎস পরিচ্ছন্ন কাজ।
মিরনজিল্লাহ হরিজন পল্লীতে বসবাসকারীরা কোনোভাবেই অবৈধ হতে পারে না একথা উল্লেখ করে মানববন্ধনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, তাদের অবৈধ বলে উচ্ছেদ পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা জানাই।
হরিজন সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আজ থেকে আপনারা একা নয়, আমরা আপনাদের সহযোদ্ধা। আওয়ামী লীগের ২০২৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইশতেহারে সকলের জন্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্তানের অঙ্গীকার করা হয়েছে। তাহলে হরিজনদের বাসতি কেন উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
পুলিশ দিয়ে হরিজন পল্লী উচ্ছেদ করতে আসলে বিশৃঙ্খলার দায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রকে বহন করতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত থেকে মেয়রকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি বলেন, মেয়র হিসেবে আপনি হরিজন পল্লীতে আসুন। দেখে যান, তারা কেমন মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
হরিজন পল্লী উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত মেয়রের পক্ষ থেকে প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, এখানে উচ্ছেদ অভিযান চালাতে আসলে জনগন কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলবে না। আমরা সক্রিয় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে থাকব।
যাদের উচ্ছেদ করতে চাচ্ছেন তাদের ভোটেই কিন্তু ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র হয়েছেন একথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথ বলেন, কিছু ভূমিদস্যু, ঘুষখোর হরিজন পল্লী উচ্ছেদে মেয়রকে কুমন্ত্র দিচ্ছে। তা না হলে ৪০০ বছরের বসতি উচ্ছেদ কেন।
মেয়রের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীরের মতো একদিন আপনার অবস্থা হবে। আপনার সকল কর্মের হিসাব নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, অশুভ শক্তির পরামর্শে হরিজনদের উচ্ছেদ না করে, তাদের বসবাসের জন্য ১০তলা ভবন করে দিন।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ বলেন, পুনর্বাসনের আগে হরিজন পল্লীতে উচ্ছেদ চলবে না, চললে দাঁতভাঙা জবাব দেব। রাজপথে আন্দোলন চলবে।
ঢাকা মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ড. তাপস চন্দ্র পাল বলেন, রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য সমঅধিকার চাই।
৪০০ বছরের বসতি হরিজন পল্লী পৃথিবীর কোনো আইনে উচ্ছেদ করতে পারবে না জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, দুর্বল ও প্রান্তিক ভেবে সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের মতো দেশজুড়ে হিন্দুদের জমি দখল চলছে। সংখ্যালঘু বলেই হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষ রাষ্ট্রের নাগরিক হলেও তারা অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন।
তাদের উচ্ছেদ কেন এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, মিরনজিল্লাহ হরিজন পল্লীর এক ইঞ্চি জমিও উচ্ছেদ হতে দেব না।
বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের সভাপতি কৃষ্ণলালের সভাপতিত্বে মানবন্ধনে বক্তব্য রাখেন, পদ্মাবতী দেবী, প্রাণতোষ আচার্য জিতু, গিরিধারি সাহা, রবীন্দ্রনাথ বসু, পংকজ বাসফোর, হুদয় দাস হেলা প্রমুখ।
মানবন্ধনে হরিজন সম্প্রদায়ের কয়েকহাজার মানুষ অংশ নেন। কর্মসূচি শেষে মিছিল নিয়ে নগর ভবন ঘেরাও করেন তারা। এসময় রাস্তার দু’পাশে আধাঘণ্টা যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে উপস্থিত পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল মেয়র দেশের বাইরে থাকায় সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার মো. মিজানুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দাবি দাওয়া তুলে ধরেন। নির্বাহী কর্মকর্তা মেয়রের কাছে দাবি দাওয়া জানানোর প্রতিশ্রুতি দেন।
মন্তব্য করুন