রাজধানীর বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে লাগা আগুনে নারী-শিশুসহ মারা যায় ৪৫ জন। তাদের মধ্যে ৩৯ জনের পরিচয় জানা গেছে। এ নিহতের তালিকায় রয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুই শিক্ষার্থী।
ভয়াবহ ওই ঘটনায় ভবনে জীবনের আলো নিভে যাওয়া বুয়েটের দুই শিক্ষার্থী হলেন, লামিশা ইসলাম ও নাহিয়ান আমিন।
গতকার রাতে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেছিলেন, ‘আমাদের একজন সহকর্মীর মেয়ে মারা গেছেন।’ সেই মেয়েটিই নিহত লামিশা ইসলাম।
এ ঘটনায় বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক আবেগঘন বার্তা দিয়েছেন। সেই পোস্টের সূত্র ধরে জানা যায়, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে কর্মরত অতিরিক্ত ডিআইজি মো. নাসিরুল ইসলামের মেয়ে নিহত লামিশা ইসলাম।
নিহত লামিশা ইসলামসহ ২ বোনকে ছোটবেলায় রেখে মা মারা যায়। বেইলি রোডে আগুন আবারও থমকে দিল পরিবারটিকে।
বুয়েট শিক্ষার্থী নিহত লামিশা ইসলামকে নিয়ে সুদীপ কুমার চক্রবর্তীর বার্তাটি উপস্থাপন করা হলো-
# ‘জীবন এত ছোট কেনে, এ ভুবনে?’
‘জনাব মো. নাসিরুল ইসলাম বিপিএম স্যার অতি. ডিআইজি (রিক্রুটমেন্ট অ্যান্ড ক্যারিয়ার প্ল্যানিং-১) হিসেবে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে কর্মরত। পুলিশ সার্ভিসে যোগদানের পর হতেই নাসির স্যারকে একজন পেশাদার, নিবেদিত, দক্ষ, চৌকস কর্মকর্তা হিসেবে দেখে এসেছি। বাংলাদেশ পুলিশে পরিবর্তিত পদ্ধতিতে শতভাগ স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা, সততা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত পূর্বক ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল নিয়োগ পদ্ধতির অন্যতম রূপকার তিনি।’
‘২০১৮ সালে হঠাৎ স্যারের সহধর্মিণী শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। স্যারের দুই কন্যা। তারা তখন বয়সে অনেক ছোট ছিল। আত্মজাদ্বয়ের দিকে তাকিয়ে স্যার পুনর্বার দ্বার পরিগ্রহ করেননি। স্যারের কন্যাদ্বয় ক্রমান্বয়ে স্বাবলম্বী, আত্মপ্রত্যয়ী, মেধাবী সন্তান হিসেবে স্যারের স্নেহমমতায় বড় হয়ে উঠে।’
‘রমনা পুলিশ কমপ্লেক্সের শিমুল ভবনের চারতলায় আমাদের বাসা ছিল আর তিনতলায় স্যারের বাসা। মাঝেমধ্যে লিফটে স্যার এবং স্যারের কন্যাদ্বয়ের সাথে দেখা হতো। একদিন হঠাৎ জানতে পারি স্যারের বড়ো আত্মজা লামিশা ইসলাম বুয়েটে ভর্তি হয়েছে। শুনে যারপরনাই আনন্দিত হই। মাতৃহীন সন্তানরা পিতার স্নেহে গর্বিত সন্তান হিসেবে সাফল্যের মুকুট ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।’
‘২৭ ফেব্রুয়ারি হতে বার্ষিক পুলিশ সপ্তাহ সূচনা হওয়ায় ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে ব্রিফিং শেষ করে জরুরি প্রয়োজনে শিমুল ভবনে যাই। লিফট দিয়ে ওঠার সময় লামিশার সাথে দেখা হয়। তার বুয়েট ভর্তি হওয়া নিয়ে গর্ব অনুভব করতে পারি। তখন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি মৃত্যু তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।’
‘২৯ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সপ্তাহের অংশ হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সাথে কর্তব্যরত কর্মকর্তাদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান চলছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে। হঠাৎ শুনতে পারি বেইলি রোডে বহুতল ভবনের কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এবং নাসির স্যারের কন্যা আটকে পড়েছে। সম্ভবত সে ছাদে আশ্রয় নিয়েছে এবং তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে শুনতে পেরে স্বস্তিবোধ করি। এরপর অনুষ্ঠান শেষে বাসায় চলে আসি।’
‘উৎকণ্ঠা থেকে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সংবাদ দেখার এক পর্যায়ে আইজিপি মহোদয়ের ঘটনাস্থল হতে মিডিয়া ব্রিফিং প্রত্যক্ষ করে জানতে পারি যে, আমাদের একজন সহকর্মীর কন্যা ওই ভবনে সংঘটিত ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুবরণ করেছেন। তখনও নিশ্চিত ছিলাম না প্রয়াতের পরিচয় নিয়ে। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো প্রাপ্ত দুঃসংবাদে চরম ব্যথিত, বিস্মিত ও স্তম্ভিত হয়ে পড়ি। নাসির স্যারের বড় আত্মজা বুয়েটের কেমিকৌশল শিক্ষার্থী লামিশা ইসলাম মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ড মৃত্যুবরণ করেছে। তার বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করি। স্যার এবং স্যারের ছোট আত্মজার প্রতি গভীর সমবেদনা।’
‘বেইলি রোডের বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৪৫ জনের প্রতি গভীর শোকপ্রকাশ এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা পোষণ করছি।’
মন্তব্য করুন