অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মো. আসাদুজ্জামান বলেন, জুলাই হত্যাকাণ্ডে পলাতকদের ফিরিয়ে আনা হবে। বিগত শাসনামলে দেশে এক ব্যক্তির শাসন ছিল। শেখ হাসিনার মিথ্যাচার গোয়েবলসকেও হার মানিয়েছে।
শনিবার (১২ অক্টোবর) রাজধানীর এফডিসিতে জুলাই হত্যাকাণ্ডের দায় নিয়ে আয়োজিত ছায়া সংসদে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মো. আসাদুজ্জামান এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, শেখ হাসিনা এত মিথ্যা বলেছেন, এমনভাবে বলেছেন, এমন কৌশল করে বলেছেন, তিনি নিজেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে, তিনি যা বলেন সেটাই সত্য, সেটাই বেদবাক্য। তিনি মিথ্যা বলতে বলতে মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন। তার মিথ্যাচার গোয়েবলসকেও হার মানিয়েছে। গোয়েবলস বেঁচে থাকলে তিনি হয়তো শেখ হাসিনার ছাত্র হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতেন।
মো. আসাদুজ্জামান বলেন, জুলাই-আগস্টের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালিয়ে নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে বড় কালো দাগ হয়ে থাকবে। পাঠ্যপুস্তকে রচিত হবে জুলাই বিপ্লবের এসব শহীদদের শোকগাথা। রক্তপিপাসু জুলুমবাজ সরকারের অন্যায়-অত্যাচারের নির্মম চিত্র। তারা চেয়েছিল রক্তের উপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে। কিন্তু মৃত্যুকে ভয় না পাওয়া ছাত্র-জনতা যখন রাজধানী ঘিরে ফেললো- এক কাপড়ে পালিয়ে গেল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফ্যাসিবাদের মুখপাত্র হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগসহ তাদের জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলো এ হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রধানত দায়ী। তবে নির্বাচন কমিশন, র্যাব-পুলিশ, বিজিবিসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনীর জনবিরোধী অবস্থানের কারণে জুলাই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপকতা বেড়েছে। তাই জুলাই হত্যাকাণ্ডের দায় শেখ হাসিনাসহ দলীয় স্বৈরতন্ত্রের পাশাপাশি প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র সমানভাবে দায়ী। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার প্রশাসনের বেশিরভাগ ব্যক্তিই এ হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, নানা অন্যায় সুবিধা নিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তৎকালীন প্রশাসনের আমলা, র্যাব-পুলিশ এই গণহত্যার নেপথ্যে খলনায়কের ভূমিকায় কাজ করেছে। আমি-ডামি নির্বাচন, দিনের ভোট রাতে করার মাধ্যমে যারা স্বৈরাচার সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছিল, যারা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জ্বালানি ও আর্থিক খাতকে ধ্বংস করেছে, তারাও জুলাই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অনেক অপরাধী দেশে-বিদেশে পালিয়ে রয়েছে। কেউ কেউ ধরা পড়েছে, আমলাদের অনেকেই এখনো প্রশাসনে ঘাপটি মেরে আছে। এদের দ্রুত বিচার করা না হলে শহীদদের আত্মার সঙ্গে বেইমানি করা হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে ছাত্র-জনতার এই বিপ্লব ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যর্থ হবে। দেশ সংকটের মুখোমুখি হবে। ফ্যাসিস্টরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তাই জুলাই হত্যাকাণ্ডের দোসরদের শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত।
জুলাই হত্যাকাণ্ডে দায়ীদের উপযুক্ত বিচারের লক্ষ্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী নিম্নে ১০ দফা সুপারিশ করেন-
১. জুলাই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী, নির্দেশদাতা, গুলিবর্ষণকারীসহ হত্যাকাণ্ডে জড়িত রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তালিকা প্রস্তুত করা। ২. শেখ হাসিনাসহ যারা বিদেশে পালিয়ে গিয়েছে তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা। জুলাই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত যারা ভারতে অবস্থান করছে তাদের বন্দি বিনিময় চুক্তির আওতায় দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা। ৩. গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও ও ছবি সংগ্রহ করে গণহত্যার তথ্যচিত্র তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা। এই তথ্যচিত্র নির্মাণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক মাহবুবুল আলমের নেতৃত্বে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরকে সম্পৃক্ত করে একটি কমিটি করা। যে তথ্যচিত্র বিচার প্রক্রিয়ার কার্যক্রমে সহায়তা করবে। ৪. জুলাই হত্যাকাণ্ডে আহত ও নিহতদের তালিকা তৈরি করে তাদের পরিবারকে নগদ আর্থিক সহযোগিতা, প্রয়োজন অনুযায়ী আবাসন ব্যবস্থা, আহতদের দ্রুত উন্নত চিকিৎসা প্রদান, পরিবারের উপযুক্ত ব্যক্তিদের চাকরির ব্যবস্থা করাসহ স্থায়ীভাবে মাসিক ভিত্তিতে ভাতা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৫. জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলগুলো ভবিষ্যতে রাজনীতি করতে পারার নৈতিক অধিকার রাখে কি না তা নিয়ে গণভোটের উদ্যোগ নেওয়া।
৬. জুলাই গণহত্যার অভিযোগে ঢালাওভাবে মামলা প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি প্রদানে বাধা তৈরি করতে পারে। তাই গণহত্যায় অভিযুক্ত নয় এমন ব্যক্তিদের যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে যতদ্রুত সম্ভব মামলা থেকে অব্যহতি দেওয়া। তা নাহলে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর মানুষের আস্থার ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
৭. বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে বিবাদী পক্ষকে সব আইনি সুবিধাপ্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করা।
৮. নিহত অনেককে পোস্টমর্টেম ছাড়া দাফন করতে হয়েছে। এ বিষয়ে কি করা যায় তার উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৯. পতিত সরকারের সহযোগিতাকারী আইন, বিচার ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা।
১০. কোন মামলাগুলো দেশীয় আদালতে বিচার হবে আর কোন মামলাগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার করা হবে তার দিকনির্দেশনা প্রদান করা।
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির আয়োজনে এ ছায়া সংসদে ঢাকা কলেজের বিতার্কিকদের পরাজিত করে ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির বিতার্কিকরা বিজয়ী হয়। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন ড. এসএম মোর্শেদ, ড. একেএম মাজহারুল ইসলাম, সাংবাদিক মনিরুজ্জামান মিশন, সাংবাদিক মো. সাইদুল ইসলাম ও কবি জাহানারা পারভিন। প্রতিযোগিতা শেষে চ্যাম্পিয়ন দলকে ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।
মন্তব্য করুন