বাসস
প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৫:২৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

দেনা শোধ না করেই চির বিশ্রামে হৃদয়

শহীদ হৃদয়। ছবি : সংগৃহীত
শহীদ হৃদয়। ছবি : সংগৃহীত

ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হয়ে ছয় মাস ধরে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন হৃদয়। চিকিৎসা করাতে অনেক টাকা ঋণ করেছেন। দরিদ্র পিতার সংসারে নিজের চিকিৎসার ভার নিজেই নিয়েছিলেন হৃদয় হাওলাদার (২০)। ঋণ শোধ করার জন্য বেশি পরিশ্রম করতেন। বিশ্রাম নেওয়া হতো না তার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে পুলিশের গুলিতে চিরবিশ্রামে চলে গেলেন তিনি।

ঝালকাঠির শেখেরহাট ইউনিয়নের শিরযুগ গ্রামের শহিদ হাওলাদার ও কুলসুম বেগমের পুত্র হৃদয়। তিন ভাইবোনের মধ্যে বড় তিনি। রাজমিস্ত্রীর সহকারি বাবার টানাপড়েনের সংসারে তাই হৃদয় পড়ালেখায় বেশিদূর এগুতে পারেননি। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। তারপর বাবার কাজে সহযোগিতা করতে করতেই বেড়ে উঠেছিলেন। তিন বছর আগে ঢাকায় যান ফুটপাতের কাপড়ের দোকানে কাজ করতে।

গত ১৯ জুলাই (শুক্রবার) ২০২৪। ঢাকার রাজপথ ছিল আন্দোলনকারীদের দখলে। মুখোমুখি অবস্থানে ছিলো পুলিশও। সেদিন সন্ধ্যা ৬টায় চাচাতো ভাই রিফাতকে নিয়ে মিরপুর ১০ নম্বরে যান হৃদয়। হেলিকপ্টার থেকে গুলি হচ্ছিল জানতে পেরে সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় হৃদয়ের মা ফোন দিয়ে দুজনকে দ্রুত বাসায় যেতে বলেন। হৃদয়ের শেষ কথা ছিল- ‘মা, আমরা ছাত্র-ভাইদের সঙ্গে আন্দোলনে আছি, গেট খোলা রাখো- এখনই চলে আসব’। এর এক ঘণ্টা পরই রাত ৮টায় মিরপুর ৬ নম্বরের আলোক হাসপাতালের চিকিৎসক ফোন দিয়ে বলেন, আপনার ছেলের গুলি লেগেছে, হাসপাতালে আসেন। ওই গোলাগুলির মধ্যে হাসপাতালে গিয়ে পাওয়া গেল হৃদয়ের গুলিবিদ্ধ মরদেহ। চাচাতো ভাই রিফাতও গুলিবিদ্ধ।

মরদেহের ছাড়পত্রে মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা হয়েছে ‘গান শ্যুট ইনজুরি’। হৃদয়ের অসুস্থ ফুসফুসেই বুলেটের দুই ইঞ্চি ছিদ্র। পরিবারের একমাত্র আশার প্রদীপকে হারিয়ে মা-বাবা আর দাদি এখন পর্যন্ত দুঃস্বপ্নকে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। হৃদয়ের হৃদয়ভরা স্বপ্ন ছিলো পরিবারের পাঁচ লাখ টাকার ঋণ শোধ করবেন। টিনের চালা দিয়ে যাতে আর ঘরে পানি না ঢোকে এমন একটি সুন্দর ঘর তুলবেন। ছোট দুই ভাইবোনকে পড়ালেখা করাবেন। বাবাকে যাতে রাজমিস্ত্রীর সহকারি হিসেবে দিনের পর দিন না খাটতে হয় তার স্থায়ী ব্যবস্থা করবেন। সব স্বপ্ন লুটে নিলো শট গানের বুলেট।

হৃদয়ের মা কুলসুম বেগমের আহাজারি থামে না- ‘আমার বাবায় টাকা আয় করতো- কিন্তু একটা ভালো জামা গায়ে দিত না। অসুস্থ বাবায় বিছানায় রেস্টে থাকে নাই, শেষবার ঢাকা যাওয়ার আগেও কইছে- মা, আমরা চার-পাঁচ লাখ টাকা দেনা হইছি- কেমনে রেস্টে থাকমু।’

দাদি আনোয়ারা বেগমের বুকভাঙ্গা আহাজারি- ‘আমার দরদ আমার ভাই ছাড়া আর কেডা বোঝবে? আল্লায় আমারে নিয়া আমার ভাইরে বাঁচাইয়া রাখতো!’

জানা যায়, মৃত্যুর ৭ দিন আগে ১২ জুলাই ঝালকাঠি থেকে স্ব পরিবারে ঢাকায় ফুপাতো বোনের বিয়েতে যান হৃদয় হাওলাদার। চাচার বাসা মিরপুর ১১ নম্বরে সবাইকে নিয়ে ওঠেন। ঢাকায় হৃদয় চাচার বাসাতেই থাকতেন। চাচা ইমাম হাওলাদার একটা বাড়ির কেয়ারটেকার। সেখানেই দুই চাচাতো ভাই শিমুল ও রিফাতের সাথে থাকতেন হৃদয়। দুই ভাই একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান সময় ভাগ করে। আর হৃদয় ফুটপাতের কাপড়ের দোকানের কর্মচারী।

হৃদয়ের বাবা শহিদ হাওলাদার বলেন, সেদিন রাতেই মরদেহ ঝালকাঠিতে আনতে চাইলেও কারফিউয়ের কারণে অ্যাম্বুলেন্সের চালক রাজি হননি। রাতে পুলিশের চোখ এড়িয়ে মরদেহ মিরপুর ১১ নম্বরে চাচার বাসায় নিয়ে গোসল করিয়ে ফ্রিজিং গাড়ি ভাড়া করে সারারাত সেখানেই রাখা হয়। পরদিন ভোরে ফজরের নামাজের পর শতাধিক মুসল্লির উপস্থিতিতে জানাযা শেষে কালশি কবরস্থানে দাফন করা হয়।

তিনি জানান, বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন হৃদয়। ফুসফুসে পানি জমে গিয়েছিলো। অস্ত্রোপচার করে সে পানি বের করা হয়েছিলো। রাজধানীর মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, বরিশালে শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ইসলামিয়া হাসপাতালে ছয় মাস চিকিৎসা নিয়েছিলেন। অভাবের সংসারে অনেক ধার-দেনা করে চিকিৎসা করতে হয়েছে। সেই দেনা শোধ করতে হৃদয় পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠার আগেই মৃত্যুর সাত দিন আগে ঢাকায় এসে ফুটপাতের কাপড়ের দোকানে পুনরায় কাজ শুরু করেন।

হৃদয়ের বাবার আহাজারি, ‘আমার ছেলেটার ফুসফুসে আগেই ৮ ইঞ্চি কাটা ছিল। ডান বুকে আরও ২ ইঞ্চি ছিদ্র করে দিয়েছে স্বৈরাচারের বুলেট।’ নিজেকে কোনোভাবেই সামলাতে পারেন না তিনি। বারবার ঢাকায় যান ছেলের কবর দেখতে। গত দুমাসে ছেলের কবর দেখতে চার বার ঢাকা গিয়েছেন শহিদ হাওলাদার।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ঢাকার বিভিন্ন স্থানে শহিদ হওয়া ঝালকাঠির আট পরিবারের মাঝে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করেছে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। গত ২৭ আগস্ট সকালে জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে ছাত্র-জনতা ঐক্য সমাবেশের আয়োজন করে জেলা জামায়াতে ইসলামী। জেলার চার উপজেলার বাসিন্দা ঢাকায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ও চাকরিজীবীসহ মোট আট শহীদের পরিবারকে নগদ দুই লাখ টাকা করে অনুদান দেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাপ পরওয়ার। শহীদ আটজনের মধ্যে দুজন শিক্ষার্থী, দুজন চাকুরীজীবী, দুজন শ্রমিক, একজন ব্যবসায়ী ও একজন ভাড়ায় গাড়ি চালাতেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

লক্ষ্মীপুরে সেনাবাহিনীর হাতে ভুয়া পুলিশ আটক

পরিবেশ দূষণের প্রতিবাদে উত্তরা ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন

প্রিয়াঙ্কা হত্যার বিচারের দাবিতে নিটার শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন

আখাউড়ায় ভারতীয় নাগরিক মা-ছেলে আটক

মেটলাইফ-আইডিএলসি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের চুক্তি স্বাক্ষর

‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিশেষ নজর রয়েছে’

মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ স্টেশনের ট্রায়াল রান বৃহস্পতিবার

এইচটি ইমামের ছেলের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা 

দেশব্যাপী আইএফআইসি ব্যাংকের ৪৮তম বর্ষপূর্তি উদযাপন

দুদক কেন ঘুমায়, জানতে চান সারজিস

১০

কোনো দপ্তরে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা : সাতক্ষীরার ডিসি

১১

ইসরায়েলকে বাঁচাতে শক্তিধর আরব দেশের দ্বারস্থ যুক্তরাষ্ট্র

১২

ডেঙ্গুতে আরও ৫ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৯৮১

১৩

যে কারণে পিছিয়ে গেল ফুটবল মৌসুম

১৪

মন্ত্রিপরিষদ সচিব হলেন ড. শেখ আব্দুর রশীদ

১৫

টঙ্গীতে সরকারি ড্রেন বন্ধ করে ফ্ল্যাট ব্যবসায়ীর অবৈধভাবে রাস্তা নির্মাণে পাঁয়তারা

১৬

‘রাশিয়ার পক্ষে ইউক্রেনে যুদ্ধ করছে উত্তর কোরিয়ার সেনারা’

১৭

সংলাপে ডাক পাচ্ছে না জাপা 

১৮

ছাত্র আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মরণে ডেমরায় স্মরণসভা

১৯

অবসর ঘোষণায় মাহমুদউল্লাহর ভাষ্য

২০
X