পুলিশের কেন্দ্রীয় কাঠামো বাতিল করে স্বাধীন স্থানীয় সরকারের অধীনে পুলিশকে ন্যস্ত করার আহ্বান জানিয়ে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষায় পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কার’ শীর্ষক আলোচনা সভা করে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন।
মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে তারা।
দলের অর্থনৈতিক সমন্বয়ক দিদারুল ভুঁইয়ার সঞ্চালনায় এবং প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূমের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সামজীর আহমেদ।
এতে আরও বক্তব্য রাখেন, অধ্যাপক সি আর আবরার, মানবাধিকার কর্মী; খান সাঈদ হাসান, পিপিএম, ডিআইজি (অব.), বাংলাদেশ পুলিশ; অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; অধ্যাপক সৈয়দ নিজার, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, উপ-পরিদর্শক (অব.), বাংলাদেশ পুলিশ; ওয়ালিউল্লাহ বাশার, সহপ্রতিষ্ঠাতা, আলাপন; রাশেদ রাহম, আইনের ইতিহাস গবেষক প্রমুখ।
এসময় সভাপতির বক্তব্যে হাসনাত কাইয়ূম বলেন, কেন্দ্রীয় স্ট্রাকচার ভেঙে দিয়ে পুলিশকে সত্যিকারের স্বাধীন স্থানীয় সরকার গঠন করে তাদের অধীনে ন্যস্ত করতে হবে। রাষ্ট্রের সংস্কার না করে শুধু পুলিশকে সংস্কার করা যাবে না। আমরা খুব দ্রুতই আবারও এই আলোচনা করব এবং পুলিশ সংস্কার কমিশনের জন্য একটা সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করে উপস্থাপন করব।
সভায় লিখিত বক্তব্য পাঠান সাবেক আইজিপি ড. এনামুল হক। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, পুলিশ আইন ও পিআরবির অসামঞ্জস্য দূর করতে হবে। ওসি নিয়োগের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্ব দিতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে পুলিশকে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পুলিশের আর্থিক হিসাব-নিকাশ এর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। যারা এখনো যোগদান করেনি দ্রুত নোটিশ করে তাদেরকে চাকরিতে যোগদানের তাড়া দিতে হবে।
অধ্যাপক সামজীর বলেন, বাংলাদেশের পুলিশ চলে ব্রিটিশ উপনিবেশের তৈরি করা আইনে। তাই এই পুলিশ বারবারই জনগণের বিপক্ষে দাঁড়ায় এবং জুলুমের বাহিনীতে পরিণত হয়। তিনি পুলিশের নাম ও পোশাক পরিচ্ছদ পরিবর্তনের প্রস্তাব করেন। পাশাপাশি পুলিশের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে জনগণের ফিডব্যাকের ব্যবস্থা করারও প্রস্তাব করেন তিনি। সেই সঙ্গে পুলিশকে জনগণের রেগুলার সমস্যার ক্ষেত্রে অভিযোগ জানানোর জন্য ই-মেইল ও অনলাইনের ব্যবস্থা থাকারও প্রস্তাব করেন।
অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আত্মদান আমাদেরকে প্রজা থেকে নাগরিকে উন্নীত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। যেই সুযোগগুলো আমরা চাই রাষ্ট্রের কাছে, মর্যাদা নিয়ে বেচে থাকার জন্য সেগুলো আমাদেরকে খোঁজে বের করতে হবে। বিগত সময়ে পুলিশসহ সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুম, খুন, মিথ্যা মামলা, বিরোধীমত দমনসহ সকল অপকর্মই করেছে। সর্বশেষ আমলে যারা দ্রুত প্রমোশন ও সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে তাদের ব্যাপারে দ্রুত তদন্ত করে জনগণের সামনে প্রকাশ করতে হবে।
সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান বলেন, বিরোধীদলে থাকার সময় শেখ হাসিনা বলেছিলেন র্যাব বাতিল করবেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে উনি ইতিহাসের সর্বোচ্চ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য র্যাবকে ব্যবহার করেছেন। ২০ হাজার পাবলিক সার্ভেন্টকে ঠিক করতে পারলে বাংলাদেশ ঠিক হয়ে যাবে। তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় না আনতে পারলে বাংলাদেশ সংস্কার অর্থবহ হবে না।
অধ্যাপক নিজার বলেন, জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান বিগত ১০০ বছরে এতো হত্যাকাণ্ড এমনকি উপনিবেশ আমলেও হয়নি। নতুন রাষ্ট্রের মেটাপ্রিন্সিপাল হওয়া দরকার মানবিকীকরণ প্রক্রিয়া। সেই অনুযায়ী সকল উপনিবেশিক এবং পরবর্তী আইনকানুন সংস্কার করা দরকার। আমরা দ্রুতই সকল উপনিবেশিক আইনের জুলুমের ধারাগুলো জনগণের সামনে প্রকাশ করবো।
অধ্যাপক মারুফুল ইসলাম বলেন, পুলিশ যতো রকম অপরাধ নির্মুলের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রায় সকল অপরাধের সঙ্গে পুলিশ নিজে জড়িত হয়ে পড়েছে। উলটো মানুষ আইনি সহযোগিতা পেতে চাইলে নানা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। আমাদের তাৎক্ষণিক কাজ হচ্ছে, যারা চাকরিতে আছেন তাদের স্ক্রিনিং করা, তারা সৎ কিনা, কর্মক্ষম কি না ইত্যাদি। নৌ বাহিনি, বিমান বাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীর সদ্য অবসর প্রাপ্তদের পুলিশে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ করা যেতে পারে।
ওয়ালিউল্লাহ বাশার বলেন, পুলিশি সংস্কার করতে হলে বিভিন্ন মেয়াদি সমাধান নিয়ে আলাপ করতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদি সংস্কার উদ্যোগের পাশাপাশি মধ্যমেয়াদী ও স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগও নেয়া দরকার। পাশাপাশি শহীদদের ব্যাপারে আমরা যেমন সহানুভূতিশীল তেমনি পুলিশের মধ্যে যারা নিহত হয়েছেন তাদের ব্যাপারেও সহানুভূতিশীল হতে হবে।
আইন গবেষক রাশেদ রাহম বলেন, আধুনিক রাষ্ট্র হচ্ছে সম্মতির ভিত্তিতে বলপ্রয়োগ এর প্রতিষ্ঠান। এই বলপ্রয়োগকে ব্যালেন্স করার জন্য রাষ্ট্রে গণতন্ত্র দরকার। বিগত ফ্যাসিবাদী আমলে পুলিশকে খুনি বাহিনী হিসেবে জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এগুলোকে আমলে না নিয়ে সংস্কার করা যাবে না।
অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, শুধু পোশাক পরিচ্ছদ ও নাম পরিবর্তন করলে তো নয়ই এমনকি শুধু পুলিশ সংস্কার করলেও হবে না। আমাদেরকে প্রধানত শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে, নয়তো কোনো সংস্কারই টিকবে না। ৩ লেভেলে ভর্তির বদলে পুলিশে ২ লেভেলে ভর্তির প্রস্তাব করেন তিনি।
মন্তব্য করুন