দেশের বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির হার ৯ শতাংশের বেশি, যা উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির ইঙ্গিত। এমন পরিস্থিতিতেই বাজেটের প্রায় ২০ শতাংশ অর্থ অভ্যন্তরীণ খাত থেকে নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। যার আর্থিক পরিমাণ ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এটি উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণ হতে পারে বলে মনে করেন দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)।
শনিবার (৮ জুন) প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে আইসিএবির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ফোরকান উদ্দিন এ মন্তব্য করেন।
ব্যক্তির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের আর্থিক প্রতিবেদন একাধিক ছিল। বিভিন্ন কারণে তাদের অনেক অপ্রদর্শিত অর্থ রয়েছে। যেগুলো তারা তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে পারছিল না। এ সুযোগের কারণে তারা এসব অর্থ ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করতে পারবে। এতে ভবিষ্যতে দেশের প্রদর্শিত সম্পদের পরিমাণ বাড়বে এবং সরকারের করও বাড়বে। তবে ব্যক্তির অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ সম্পর্কে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ফোরকান উদ্দিন বলেন, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর জন্য করজাল সম্প্রসারণ এখন সমযের দাবি। আমরা বিশ্বাস করি ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) বাস্তবায়নে এনবিআর এবং আইসিএবির যৌথ উদ্যোগ কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব অর্জনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। ২০২০ সালের আগে প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক একাধিক প্রতিবেদন ছিল। বিশেষ করে তারা ব্যাংক এবং এনবিআরের সঙ্গে সমন্বয়ের জন্য একাধিক আর্থিক প্রতিবেদন ব্যবহার করত। কিন্তু ডিভিএস চালু হওয়ার ফলে তা অনেকটাই বন্ধ হয়েছে। এতে একটি আর্থিক প্রতিবেদন ব্যবহার করার কারণে তারা সম্পদের তথ্য গোপন করতে পারছে না। এতে সরকারের রাজস্ব বাড়ছে।
ডিভিএসের কারণে দেশের খেলাপি ঋণ কমে আসবে বলেও মনে করেন তিনি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কেউ যদি এখন ব্যাংক থেকে চাহিদার চেয়ে বেশি ঋণ নেয় তাহলে তার আর্থিক প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করতে হবে। এতে তাকে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করতে হবে। তাই কেউ অতিরিক্ত ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রেও সতর্ক হবে।
ফোরকান উদ্দিন বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট আমাদের জিডিপির ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বৈশ্বিক সংকট, ডলার সংকট, ব্যবসা-বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে মন্দা এবং অন্যান্য বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও সরকার ২লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ নিয়েছে। যা আমাদের একটি উন্নত দেশে পৌঁছার যাত্রায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
এ সময় প্রতিষ্ঠানটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ও কাউন্সিল মেম্বার হুমায়ুন কবির বলেন, আমাদের ট্যাক্সের সিস্টেমের কারণেই প্রতিষ্ঠানগুলোর অপ্রকাশিত অর্থ তৈরি হয়। এজন্য ওই সিস্টেমের পরিবর্তনের দরকার রয়েছে। আর ব্যক্তি পর্যায়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। অতীতে অন্যান্য সরকারও এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। সুতরাং এ বিষয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে অবৈধ পন্থায় উপার্জিত সম্পদ বৈধ করায় সমর্থন করেন না বলেও জানিয়েছেন তিনি।
আইসিএবির সাবেক এই প্রেসিডেন্ট বলেন, সরকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৭০ হাজার কোটি টাকা বেশি। অর্থাৎ অঙ্কের হিসেবে এটিকে চলতি অর্থবছর থেকে ১৭ শতাংশ বেশি। কিন্তু এখন পর্যন্ত চলতি অর্থবছরে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয়েছে সে হিসেবে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা কঠিন হবে। সে হিসেবে আমাদের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ২৯-৩০ শতাংশ বাড়বে। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে কি না- তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
তিনি বলেন, সরকার রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য ঠিক করেছে আমরা তার ওপর আস্থা রাখতে চাই। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের অভিজ্ঞতা বলে আমরা মাত্র একবার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পেরেছি। সে হিসেবে আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়।
লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, সাধারণত আমাদের খরচের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের পর এনবিআরের ওপর টার্গেট চাপিয়ে দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতা বিবেচনায় নেওয়া হয় না। এ কারণে লক্ষ্য পূরণও সম্ভব হয় না। তবে সরকার এনবিআরের সক্ষমতা বাড়াতে কাজ করছে বিদায় লক্ষ্যপূরণের সরকারের ওপর আস্থা রাখতে চান তিনি।
হুমায়ুন কবির বলেন, আমাদের ঘাটতি বাজেট পূরণে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এতে দেশের মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব তৈরি করবে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতের বিনিয়োগেও বাধা তৈরি করতে পারে। কারণ ডলার সংকট, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকটসহ নানা কারণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে বাধা তৈরি করছে। সরকারকে এদিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন। একইসঙ্গে যে কোনো মানি ক্রিয়েশনেই মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়ে বলেও মনে করেন তিনি।
মন্তব্য করুন