চলতি অর্থবছরের শেষ দিকে এসে বড় ধরনের সংকটে পড়তে যাচ্ছে সরকার। একদিকে ব্যয় মেটাতে ব্যাংক ঋণের নির্ভরতা বাড়ছে অন্যদিকে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে দেশের রপ্তানি খাতে। বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ নানা ধরনের সংকট এবং চ্যালেঞ্জের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে খাতটিতে। গত মে মাসে ৪০৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৬ শতাংশ কম। রপ্তানিতে এই পরিমাণ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরের ১১ মাসে আর হয়নি।
বুধবার (৫ জুন) প্রকাশিত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউরোপ ও আমেরিকাসহ সারা বিশ্বে তৈরি পোশাক, ওষুধ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত খাদ্য এবং বাইসাইকেলসহ সকল খাত মিলে দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য বিশ্ববাজারে রপ্তানি করে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) রপ্তানি আয় এসেছে ৫ হাজার ১৫৪ কোটি ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ৫ হাজার ৫২ কোটি ডলার। সেই হিসেবে ১১ মাসে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ০১ শতাংশ। আর একক মাস হিসেবে মে মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪০৭ কোটি ডলার। যা গত বছরেরে একই সময়ে ছিল ৪৮৪ কোটি ডলার। সেই হিসাবে মে মাসে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে ১৬ দশমিক ০৬ শতাংশ।
রপ্তানি আয়ের পাশাপাশি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় দু’দিক থেকেই পিছিয়ে রয়েছে দেশের রপ্তানি খাত। চলতি অর্থবছরের জন্য ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আর অর্থবছরের ১১ মাসে রপ্তানি আয় এসেছে ৫ হাজার ১৫৪ কোটি ডলার। ফলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রপ্তানি আয় কম এসেছে ৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর মে মাসের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫৩৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার। যদিও এসময়ে রপ্তানি আয় এসেছে ৪৮৪ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। সেই হিসাবে মে মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রপ্তানি আয় কম এসেছে ২৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ নানা সংকটে রপ্তানি আয় কমছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সম্প্রতি রপ্তানি প্রণোদনা কমানোর যে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে তৈরি পোশাকসহ পুরো রপ্তানি খাত। এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করলে আগামী দিনে রপ্তানি আয় আরও কমবে। আগামী বাজেটে এই বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগ থাকা দরকার বলে জানিয়েছেন তারা।
এই প্রসঙ্গে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা বলছেন, ১১ মাসে তৈরি পোশাক খাতে খুব বেশি প্রবৃদ্ধি হয়নি। গড়ে মাত্র দুই শতাংশের মতো হয়েছে। নিট পোশাকে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বাড়লেও ওভেনে এখনও সংকট রয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে এখনও যে সংকট আছে, তাতে পুরো অর্থবছর শেষে খুব ভালো কিছু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন দেশ তাদের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যে কৌশলগুলো নিয়েছে তার উপর ভিত্তি করেই চলতি মাসে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর পাশাপাশি পণ্য বৈচিত্র্যকরণ এবং নতুন বাজার খোঁজার ক্ষেত্রেও তারা কাজ করছে বলে জানান।
বিভিন্ন খাতে রপ্তানি আয়ের উত্থান-পতন
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে তৈরি পোশাক, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য ও চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানি বাড়লেও চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত খাদ্য, আসবাব, বাইসাইকেলসহ বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানি কমে গেছে।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত ১১ মাসে মোট পণ্য রপ্তানির ৮৫ শতাংশ আয় তৈরি পোশাক খাত থেকে এসেছে। এ সময় ৪ হাজার ৩৮৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেড়েছে। যদিও এসময়ে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রপ্তানি আয় কম হয়েছে ৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
তৈরি পোশাকের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পণ্য রপ্তানি আয় চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাত থেকে এসেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে ৯৬ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ দশমিক ১৭ শতাংশ কম। এসময় হোম টেক্সটাইল খাতের রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ২৪ দশমিক ২৯ শতাংশ কমে ৭৭ কোটি ৬০ লাখ ডলারে উন্নীত হয়েছে।
এছাড়া, কৃষি পণ্যের রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে ৮৪ কোটি ৬৩ লাখ ডলারের কৃষিপণ্য রপ্তানি আয় এসেছে। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৭৮ কোটি ২১ লাখ ডলার।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, এ সময় পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানিও কমেছে ৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ। আর লক্ষ্যমাত্রা থেকে কম এসেছে ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ। হিমায়িত এবং জীবন্ত মাছের রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি কমেছে ১৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ। তবে এসময়ে প্লাস্টিক পণ্যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ। তবে সামগ্রিকভাবে সব ধরনের পণ্যেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছে।
মন্তব্য করুন