দেশের বৈদেশিক ঋণের বোঝা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এক বছরের ব্যবধানে এই ঋণ বেড়েছে প্রায় চার বিলিয়নের বেশি। আর শুধু সরকারেরই বিদেশি ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার।
এতে ২০২৩ সাল শেষে বিদেশি ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। তবে বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকট ও মূল্যস্ফীতির কারণে বেসরকারি বিদেশি ঋণ কমেছে। এর প্রভাবে দেশের বিদেশি বাণিজ্যের হিসাব ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সম্প্রতি বড় বড় মেগা প্রকল্প গ্রহণ করায় বিদেশি ঋণ বাড়ছে। প্রকল্পগুলোয় অতিরিক্ত খরচ হওয়ায় এটি দেশের জন্য সংকট তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সাল শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১০০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৭৯ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। আর দেশের বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ২০ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার।
২০২২ সাল শেষে এর পরিমাণ ছিল ৯৬ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭২ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। আর দেশের বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ২৪ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৪ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশি ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের আরও সতকর্তা অবলম্বন করার দরকার ছিল। সক্ষমতা অনুযায়ী বিদেশি ঋণ নিতে হয়। বর্তমানে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ রয়েছে, তা পরিশোধে সরকার চাপে পড়বে।
তথ্য বলছে, গত এক বছরে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি ঋণের পরিমাণ বাড়লেও কমেছে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের পরিমাণ। ২০২৩ সালে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৭ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে বেসরকারি খাতের ঋণ কমেছে ৩ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। বেসরকারি খাতের বেশির ভাগ স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ কমেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সাল শেষে বাংলাদেশে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ এসেছে ২৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। তবে এ সময়ে ঋণ পরিশোধ করা হয় ৩০ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত বছর নিট স্বল্পমেয়াদি ঋণ শোধ করা হয়েছে চার দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। গত বছর রেকর্ড পরিমাণ বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ কমার ফলে এ খাতের ঋণের স্থিতিও কমেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সাল শেষে স্থিতি কমে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে স্থিতি ছিল ১৬ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরে স্থিতি কমেছে ৪ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ভবিষতে যেন বড় অপরিকল্পিত প্রকল্প না নেওয়া হয়। যে কোনো বড় প্রকল্প নিলে ভেবেচিন্তে নিতে হবে। সস্তায় যদি জাপানিরা কোনো প্রকল্প করে দেয় তা নেওয়া যায়। তবে চীনের ঋণের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তারা যদি সস্তায় ঋণ দেয় তাহলে সেটাও নেওয়া যাবে। বর্তমানে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে, তা পরিশোধে চাপে পড়বে দেশ। তাই আগামীতে কীভাবে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ানো যায় সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সরকার গত কয়েক বছর অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের জন্য বিদেশি ঋণ নিয়েছে। বিদ্যুৎ খাতেও বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণ নেওয়া হয়। এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প অন্যতম। আবার পদ্মা রেলওয়ে, কর্ণফুলী টানেলসহ বড় কিছু প্রকল্প এখনই দরকার ছিল না। কোনো প্রকার স্টাডি ছাড়া হঠাৎ করেই এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, দেশের সরকারি-বেসরকারি বিদেশি ঋণ স্থিতি মোট জিডিপির প্রায় ২২ শতাংশ। তাই দেশের জিডিপির তুলনায় এ পরিমাণ ঋণ চাপ হবে না। বরং আরও ঋণ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র। সম্প্রতি তিনি এমন মন্তব্য করেছে। তবে বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) সন্ধ্যায় এ বিষয়ে জানতে নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হককে ফোন করা হলে তিনি সাড়া দেননি।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা। দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংক রেড জোনে চলে যাওয়ার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর থেকে সাংবাদিকদের ওপর কড়াকড়ি আরোপ শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
মন্তব্য করুন