নানা পদেক্ষেপে বাণিজ্য ঘাটতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনতে পেরেছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে অর্থাৎ জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ঘাটতি কমেছে ৬১ শতাংশ। বাণিজ্য ঘাটতি কমায় চলতি হিসাবেও বড় ধরনের উদ্বৃত্ত দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ছয় মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৫৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আগের বছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল এক হাজার ২৩১ কোটি ২০ লাখ ডলার। অর্থাৎ ছয় মাসে বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে ৭৭১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। একটি দেশের আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের মধ্যকার পার্থক্যই হচ্ছে সেই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে তিন হাজার ৫৮ কোটি ডলারের পণ্য ও সেবা আমদানি হয়। এর বিপরীতে রপ্তানি আয় আসে দুই হাজার ৫৯৮ কোটি ডলার। বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসার পেছনে ভূমিকা রেখেছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ।
চলতি হিসাবেও বড় উদ্বৃত্ত
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাণিজ্য ঘাটতি কমায় চলতি হিসাবে বড় ধরনের উদ্বৃত্ত তৈরি হয়েছে। অর্থবছরের ছয় মাসে উদ্বৃত্ত আছে ১৯২ কোটি ৭০ লাখ ডলার। যদিও গত অর্থবছরের একই সময়ে ৪৯২ কোটি ২০ লাখ ডলারের ঘাটতি ছিল।
সাধারণভাবে চলতি হিসাবের মাধ্যমে দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝানো হয়। আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে সাধারণত কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করতে ঋণ নিতে হয়। এ ছাড়া, চলতি হিসাবের ভারসাম্য উদ্বৃত্ত থাকায় বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কোনো দেশের বাণিজ্য ঘাটতি বেশি হলে আর সেই সঙ্গে চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়। এতে তাদের বিনিয়োগ ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এ কারণেই চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক হলে বিদেশি বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে বর্তমানে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ারও বেশ সম্ভাবনা রয়েছে।
সামগ্রিক লেনদেনেও ঘাটতি কমেছে
চলতি হিসাব ইতিবাচক থাকায় ডিসেম্বর শেষে সার্বিক ভারসাম্য হিসাবের ঘাটতির পরিমাণও কিছুটা কমেছে। অর্থবছরের ছয় মাসে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৬৭ কোটি ২০ লাখ ডলার, এক বছর আগে যা ছিল ৬৪৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার। অর্থাৎ সামগ্রিক লেনেদেনে (ওভারঅল ব্যালান্স) ঘাটতি কমেছে প্রায় অর্ধেক। লেনদেন ভারসাম্যের হিসাব বলতে বিভিন্ন দিক থেকে বা বিভিন্ন হিসাবে একটি দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও সরকারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্য সব দেশের নাগরিক, সরকার ও প্রতিষ্ঠানের যে লেনদেন হয় তার সামগ্রিক হিসাব বোঝায়।
এদিকে, আর্থিক হিসাবের ঘাটতিও কিছুটা কমেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশের আর্থিক হিসাবের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৩৯ কোটি ডলার, যা জুলাই-নভেম্বর শেষে ছিল ৫৪৮ কোটি ডলার। সেই হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি কমেছে খুবই সামান্য।
তবে, গত বছরের একই সময়ে এই হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ১৪৪ কোটি ডলার। মূলত কোনো দেশের বিদেশি লেনদেনর ভারসাম্য বা ব্যালেন্স অব পেমেন্টের (বিওপি) একটি প্রধান উপাদান এই আর্থিক হিসাব। গত অর্থবছরের আর্থিক হিসাবের পরিস্থিতি তার আগের অর্থবছরের চেয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল, তখন আর্থিক হিসাবে ১৪৪ মিলিয়ন ডলারে উদ্বৃত্ত ছিল। কিন্তু, ডলার আসার চেয়ে বহিঃপ্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষে আর্থিক হিসাবের পরিস্থিতি আশানুরূপ ছিল না। ফলে, এক বছর আগের ১৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্তের বিপরীতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি ছিল ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। আর্থিক হিসাবে বিদেশি বিনিয়োগ, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ, বৈদেশিক ঋণ ও দায় পরিশোধ, বন্ডে বিনিয়োগ ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে।
মন্তব্য করুন