বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও কমে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বুধবার রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার। এর আগের দিন মঙ্গলবার রিজার্ভের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলারের উপরে ছিল।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত ঋণ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যুক্ত হওয়ায় চলমান ডলার সংকটের মধ্যেও রিজার্ভ বেড়েছে। যদিও এ সময়ে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় খুব বেশি বাড়েনি। অন্যদিকে আমদানির চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া গত মাসে আকুর বিল পরিশোধে অনেক বেশি ডলার ব্যয় করতে হয়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভ ফের কমতে শুরু করেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশে চলমান ডলার সংকটের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ রমজানের পণ্য আমদানিতে ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজন অনুযায়ী ডলার সরববাহ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যার ফলে কমছে রিজার্ভ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত জানুয়ারি মাসে দেশের রিজার্ভ কমেছে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। গত ৩ জানুয়ারি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৭০০ কোটি বা ২৭ বিলিয়ন ডলার। সংকটের কারণে ডলার বিক্রি অব্যাহত থাকায় ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫০৯ কোটি (২৫ দশমিক ০৯ বিলিয়ন) ডলারে। অর্থাৎ জানুয়ারি মাসেই রিজার্ভ কমেছে প্রায় ২শ কোটি বা ২ বিলিয়ন ডলার। আর গত বছরের একই সময়ের তুলনায় গ্রস রিজার্ভ কমেছে সাত বিলিয়নেরও বেশি। ২০২১ সালের আগস্টে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়নের ঘর ছাড়িয়েছিল। এরপর রিজার্ভ থেকে ২৯ বিলিয়ন ডলারের মতো বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিকে, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী বিপিএম-৬ মেথডের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবের সঙ্গে ৫২১ কোটি (৫ দশমিক ২১ বিলিয়ন) ডলারের পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী গ্রস রিজার্ভ এখন এক হাজার ৯৯৪ কোটি ডলার বা ১৯ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ কমেছে প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জানুয়ারির শুরুতে বিপিএম-৬ অনুযায়ী ছিল ২৩ দশমকি ৩৭ বিলিয়ন ডলার।
এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেওয়া হয়, প্রকাশ করা হয় না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সেই হিসাবে দেশের প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে। প্রতি মাসে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার করে এ রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো কষ্টসাধ্য হবে বাংলাদেশের জন্য। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম ৩ মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। সেই মানদণ্ডে বাংলাদেশ এখন শেষ প্রান্তে রয়েছে।
রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়, বিদেশি বিনিয়োগ, বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণ থেকে যে ডলার পাওয়া যায় তা দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তৈরি হয়। আবার আমদানি ব্যয়, ঋণের সুদ বা কিস্তি পরিশোধ, বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতা, পর্যটক বা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাসহ বিভিন্ন খাতে যে ব্যয় হয়, তার মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রা চলে যায়। এভাবে আয় ও ব্যয়ের পর যে ডলার থেকে যায় সেটাই রিজার্ভে যোগ হয়। আর বেশি খরচ হলে রিজার্ভ কমে যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও বিভিন্ন পণ্যের দাম বেশি থাকায় আমদানি ব্যয় কমেনি। এ ছাড়া করোনার পর বৈশ্বিক বাণিজ্য এখনো আগের অবস্থায় ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে, যা এখনো অব্যাহত আছে। এ সংকট দিন দিন বাড়ছে।
বাজারে ‘স্থিতিশীলতা’ আনতে রিজার্ভ থেকে নিয়মিত ডলার বিক্রি করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রিজার্ভের ধারাবাহিক পতনের পাশাপাশি ডলারের দরও বেড়েছে অনেক। ২০২১ সাল নাগাদ আমদানির জন্য প্রতি ডলার ৮৫-৮৬ টাকায় পাওয়া যেত। এখন প্রতি ডলারের জন্য ১২২-১২৩ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। এরপরও কাঙ্ক্ষিত ডলার না পেয়ে অনেকে এলসি খুলতে পারছেন না।
মন্তব্য করুন