রাজধানীর উত্তরা ও বিমানবন্দরসংলগ্ন ৩৩ একর জায়গায় আশিয়ান সিটি প্রকল্পের কার্যক্রম চালাতে পারবে আশিয়ান ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড। এ প্রকল্প নিয়ে রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) মঞ্জুর করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল ঘোষণা করেছেন আপিল বিভাগ।
আজ বুধবার (২২ নভেম্বর) আশিয়ান ল্যান্ডস ডেভেলপমেন্ট লি: কর্তৃক দায়েরকৃত একটি রিভিউ আবেদনের (নং ১৯/২০১৫) প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত রায় খারিজ করেছেন প্রধান বিচারপতি জনাব ওবায়দুল হাসান এর নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ।
উল্লেখিত রিভিউ রায়ের মাধ্যমে হাইকোর্ট বিভাগের একটি বিশেষ বেঞ্চ অপর একটি বিশেষ বেঞ্চের বিগত ১৬ জানুয়ারি, ২০১৪ তারিখের রায় বাতিল করেন। বিশেষ বেঞ্চ কর্তৃক প্রদত্ত ১৬ জানুয়ারি, ২০১৪ তারিখের রায়ে আশিয়ান ল্যান্ড ডেভলাপমেন্ট লি:-এর আশিয়ান সিটি প্রকল্প এবং এ প্রকল্পে প্রদত্ত রাজউক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সকল অনুমতিপত্র/ছাড়পত্র অবৈধ, বেআইনি এবং জনস্বার্থ বিরোধী ঘোষণা করা হয়।
আদালতে বেলাসহ আপিলকারীদের (হাইকোর্টে রিট আবেদনকারীদের) পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফিদা এম কামাল ও প্রবীর নিয়োগী শুনানি করেন, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও মিনহাজুল হক চৌধুরী। আশিয়ান সিটির পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কামরুল হক সিদ্দিকী ও আহসানুল করিম। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী রাগীব রউফ চৌধুরী, মো. হোসনে মোবারক ও রেদওয়ান আহমেদ রানজিব। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ।
মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্ট বিভাগের একটি বিশেষ বেঞ্চ বিগত ১৬ জানুয়ারি, ২০১৪ তারিখে এক বিভক্ত রায় প্রদান করেন। এ রায়ে আদালত আশিয়ান ল্যান্ড ডেভলাপমেন্ট লি:-এর “আশিয়ান সিটি” প্রকল্প এবং এ প্রকল্পে প্রদত্ত রাজউক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সকল অনুমতিপত্র/ছাড়পত্র অবৈধ, বেআইনি এবং জনস্বার্থ বিরোধী ঘোষণা করেন। দুইজন বিচাপতি আবেদনকারীদের পক্ষে রায় দিলেও একজন বিচারপতি ভিন্নমত পোষণ করেন এ রায়ে।
এ রায়ের বিরুদ্ধে আশিয়ান ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লি: একটি লিভ টু আপিল দায়ের করে। আপিলটি শুনানি না করে গত ১৬ জানুয়ারি, ২০১৪ তারিখে প্রদত্ত রায়ের দিনই জেলা প্রশাসন ১১৯৭ একর ভূমি ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে এ যুক্তিতে আবাসন কোম্পানিটি হাইকোর্ট বিভাগের বিশেষ বেঞ্চে রিভিউ আবেদন (১৯/২০১৫) দায়ের করে। রিভিউ আবেদনের শুনানি শেষে ১৬ আগস্ট, ২০১৬ তারিখে বিশেষ বেঞ্চ ১৬ জানুয়ারি, ২০১৪ তারিখের রায় বাতিল করেন। রিভিউ রায়ের বিরুদ্ধে রীট আবেদনকারীগণ সিভিল আপিল (নং ৪৫৫/২০১৭) দায়ের করেন।
রিভিউ রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকেও অপর একটি সিভিল আপিল (নং ৪৫৪/২০১৭) দায়ের করা হয়। আপিল আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে আজ আপিল বিভাগ রিভিউ রায় খারিজ করেন এবং আশিয়ান ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লি: এর “আশিয়ান সিটি” প্রকল্পটি ৩৩ একরের অধিক ভূমিতে বাস্তবায়নের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।
আশিয়ান ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লি: এর বিরুদ্ধে ২৩০ একরের অধিক ভূমিতে আশিয়ান সিটি প্রকল্প বাস্তবায়নে ভূমিদস্যুতার এবং জলাশয় আইন, ২০০০; পরিবেশ আইন, ১৯৯৫; ল্যান্ড হোল্ডিং লিমিটেশন অর্ডার, ১৯৭২; ল্যাণ্ড রিফর্ম অর্ডিনেন্স, ১৯৮৪; বেসরকারি আবাসন প্রকল্প (ভূমি উন্নয়ন) বিধিমালা, ২০০৪ এবং রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ ভঙ্গের অভিযোগে জনস্বার্থমূলক মামলাটি দায়ের করা হয়। একইসঙ্গে এ মামলায় প্রকল্প অনুমোদনে পূর্ত মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, রাজউক এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে অস্বচ্ছতা এবং ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়।
রাজউক ২০০৭ সালে জলাশয় ভরাটের অভিযোগে আশিয়ান সিটি প্রকল্পের বিরুদ্ধে জলাশয় আইনে মামলা দায়ের করে। শুনানিতে হাজিরা না দেওয়ায় মামলাটি আশিয়ান সিটির স্বপক্ষে খারিজ হয়ে যায়, যার বিরুদ্ধে রাজউক কোন আপিল করেনি। বিভিন্ন সময়ে রাজউক এ প্রকল্প অননুমোদিত বিধায় এতে প্লট না কিনতে ক্রেতা সাধারণকে বিজ্ঞপ্তি মারফত অনুরোধ জানায়। পরিবেশ অধিদপ্তরও জলাশয় ভরাটের অভিযোগে পরিবেশ আইনের অধীনে আশিয়ান সিটি প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করে। আশিয়ান সিটি প্রকল্প কর্তৃপক্ষের আপিল আবেদনের প্রেক্ষিতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় কোনরূপ যৌক্তিক কারণ না দেখিয়ে সেই জরিমানা কমিয়ে ৫ লাখ টাকা প্রদানের নির্দেশ দেয়। আশিয়ান সিটি প্রকল্প কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ভূমিদস্যুতার অভিযোগ উঠলে জেলা প্রশাসক, ঢাকা এক রিপোর্ট প্রদান করেন যাতে দেখা যায় যে মাত্র ৪১ একর জমির স্বপক্ষে কিছু কাগজাদি দেখাতে পারলেও আশিয়ান সিটির নামে প্রায় ২৩০ একর ভূমি ভরাট করা হয়েছে যা বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী “প্লাবনভূমি”।
জেলা প্রশাসকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ভরাটকৃত জমিতে সরকারি এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি রয়েছে। ভুক্তভোগী জমির মালিকদের বার বার অভিযোগ সত্ত্বেও আশিয়ান সিটি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক জমি দখলের ব্যাপারে রাজউক, পুলিশ বা ভূমি প্রশাসন কেউ কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
প্রথমে জলাশয় ভরাটের অভিযোগে আশিয়ান সিটি প্রকল্পের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলেও রাজউক ৪ অক্টোবর, ২০১২ তারিখে ২০টি শর্ত সাপেক্ষে এ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। প্রকল্পের জমির শতভাগ মালিকানা না থাকলেও এবং প্রকল্পের লেআউট প্ল্যান অনুমোদন ছাড়াই শর্ত সাপেক্ষে প্রদত্ত এ অনুমোদন ২০০৪ সালের বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন বিধিমালার লংঘন দাবি করে তা চ্যালেঞ্জ করে মামলার বাদীগণ। আশিয়ান সিটি প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে জলাশয় ভরাটের অভিযোগে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করে এবং বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর কর্তৃক আশিয়ান সিটি প্রকল্প এলাকাকে প্লাবনভূমি বর্ণনা করা সত্ত্বেও পরবর্তীতে এ প্রকল্পের স্বপক্ষে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র স্ববিরোধী এবং বেআইনি বলে মামলাটি চ্যালেঞ্জ করা হয়।
আশিয়ান ল্যান্ডস ডেভলাপমেন্ট লি: কর্তৃক প্রকল্পের জন্য ল্যান্ড হোল্ডিং লিমিটেশন অর্ডার ১৯৭২ এবং ল্যান্ড রিফর্ম অর্ডিনেন্স, ১৯৮৪-তে নির্ধারিত ভূমির পরিমাণের সর্বোচ্চ সিলিং-এর অতিরিক্ত জমি দখলে রাখার অভিযোগ আনা হলে আদালত তা আমলে নেন এবং জমির এরূপ মালিকানা আইন বহির্ভূত মর্মে রায় দেন।
মন্তব্য করুন