বার্ষিক ৫০ লাখ টন তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান আর্জেন্ট এলএনজির সঙ্গে একটি অবাধ্যতামূলক (নন-বাইন্ডিং) চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। এর আওতায় বাংলাদেশকে বছরে ৫০ লাখ টন এলএনজি সরবরাহ করবে প্রতিষ্ঠানটি।
এই চুক্তির বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের আইডিতে একটি পোস্ট করে জানান বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী। এরপর চুক্তিটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
এবার বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন আশিক চৌধুরী। মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) নিজের আইডিতে দীর্ঘ একটি স্ট্যাটাসে চুক্তির আদ্যোপান্ত খোলাসা করেন তিনি। এতে বিভিন্ন মহলে ওঠা কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দেন তিনি।
পোস্টে আশিক চৌধুরী লেখেন, ‘এলএনজি চুক্তি সাইনিংটা নিয়ে অনেকে অনেক প্রশ্ন করেছেন। সামারি করে জবাব দেবার চেষ্টা করছি। যারা সাহস জুগিয়েছেন, দুইটা ভালো কথা বলেছেন, তাদের অনেক ধন্যবাদ। যারা প্রশ্ন করেছেন, তাদেরকেও ধন্যবাদ। সরকারের জনগণের কাছে জবাবদিহিতা থাকাটা জরুরি। তারা জনগণের প্রশ্নের উত্তর দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।’
‘দেশে গ্যাস থাকতে আমদানি কেন?’ এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘আমাদের ইন্ডাস্ট্রিগুলা অলরেডি গ্যাস নিয়ে অনেক স্ট্রাগল করছে। এই মুহূর্তে গ্যাসের যে ফোরকাস্ট আছে, তাতে একটা লং টার্ম পরিকল্পনা না করলে আমাদের সমস্যা আর প্রকট হবে। ১০০% নিজের গ্যাস সাপ্লাইয়ের সম্ভাবনা প্রায় ০%। সেই পরিমাণ গ্যাসের সন্ধান আমাদের নেই। তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বসলেই এটা জানতে পারবেন।’
‘হেডস অব অ্যাগ্রিমেন্ট সাইনিংয়ের মানে কি?’ আশিক চৌধুলী বলেন, ‘যারা ইন্ডাস্ট্রি প্রফেশনাল আছেন, তারা জানেন, বাইন্ডিং কন্ট্রাক্ট সাইন করার আগে অনেকগুলা ধাপ আছে। সবচেয়ে প্রথম ধাপ হচ্ছে একটা নন-বাইন্ডিং কন্ট্রাক্ট সাইন করা যেখানে মূল কয়েকটা বিষয় বলা থাকে। এসব মূল বিষয় থেকে শুরু করে টেকনিক্যাল সব ডিটেইল সামনে আলোচনা হয়। এটা সেই আলোচনা শুরুর প্রথম ধাপ।’
‘দেশের আইন মানা হয়েছে?౼ জি, Public Procurement Act, 2006, Public Procurement Rules, 2008 আর Foreign Private Investment (Promotion and Protection) Act, 1980, সবগুলো আইন ফলো করেই কাজ হচ্ছে। এসব নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে ইন্টারনালি। দরপত্র আহ্বান/ টেন্ডারিং ইত্যাদি করেই এগোনো হবে। একটু ধৈর্য ধরুন।’
‘আমেরিকা অনেক দূর। দাম বেশি পড়ে যাবে না?౼ আমেরিকায় নিউইয়র্ক মার্কেন্টাইল এক্সচেঞ্জের হেনরি হাব ফিউচার কন্ট্রাক্টকে ইনডেক্স করে প্রাইসিং হয়। তার সাথে সাধারণত মার্জিন আর ফিক্সড কস্ট যোগ করা হয়। এই মার্জিন আর ফিক্সড কস্ট মেথড সবই চুক্তি নেগোসিয়েশনের অংশ। এগুলা কোনোটাই সেট ইন স্টোন না। বাইন্ডিং চুক্তির আগে এসব স্ক্রুটিনি হবে। দিনশেষে এই চুক্তি বাইন্ডিং আমরা তখনই করব, যখন বাংলাদেশের জন্য বেস্ট সলুশন হবে।’
‘২০৩০ নিয়ে এখন কথা কেন?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাদের একটা মেজর ইস্যু হচ্ছে আমরা খালি ফায়ার ফাইট করি। লং টার্ম প্ল্যান করি না। এনার্জি ইন্ডিপেন্ডেন্ট হতে হলে ১৫-২০ বছরের প্ল্যান করতে হবে।’
‘বিডা কেন এর মধ্যে? বিডা কী হিসেবে সাইন করল? এফডিআইয়ের সঙ্গে কী সম্পর্ক?’ এসব প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের মূল দায়িত্ব দেশে লোকাল এবং ফরেন বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়া। এই মুহূর্তে গ্যাসের অভাব আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে একটা। এটার তাৎক্ষণিক এবং সুদূরপন্থী সলিউশন বের করতেই হবে। ইনভেস্টরকে ডেকে এনে গ্যাস দিতে না পারলে সে আসবে না। আর আসলেও এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হবে যে তারপর আর কেউ আসতে চাইবে না। এ রকম অনেক দিন ধরে হয়ে আসছে। এভাবে চললে এফডিআই নম্বরটা এরকম দুর্বলই থাকবে। তাই আমরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ফ্যাসিলিটেটরের কাজ করছি। এই চুক্তিতেও বিডা সেই কারণেই স্বাক্ষর করেছে। এ ক্ষেত্রে প্রথম স্টেপের পর বিডা সরে আসবে আর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় টেক ওভার করবে। জ্বালানি ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টারা এবং সচিবরা সবাই মিলেই ব্যাকগ্রাউন্ড এ কাজ করেছে।’
‘২০৩০-এর একটা চুক্তি, তাও আবার প্রাইভেট একটা কোম্পানির সঙ্গে, আমেরিকান সরকারের সঙ্গে না কেন?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমেরিকার গ্যাস এক্সপোর্ট ইন্ডাস্ট্রি সম্পূর্ণ প্রাইভেট সেক্টর অপারেটেড। সরকার কোনো পার্টি না। ট্রাম্পের এনার্জি এক্সপোর্ট পলিসি কিন্তু প্রাইভেট সেক্টরকে নিয়েই। ভালো প্রাইস পেতে হলে আমাদের আর্লি এনগেজ করতে হবে।’
‘আর্জেন্ট এলএনজি কোম্পানির বয়স তো মাত্র দেড় বছর। পারমিট ও সব নেই। এদের সঙ্গে কেন?’ আশিক বলেন, ‘এই সেক্টরে প্রজেক্ট কোম্পানি একটা মার্কেট প্র্যাকটিস। বাইডেন সরকার এনার্জি এক্সপোর্ট নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। তাই প্রজেক্ট এত দিন আলমোস্ট নন-অপারেটিভ ছিলো। ট্রাম্প সরকার আসার সঙ্গে সঙ্গে এক্সপোর্ট ফ্রেন্ডলি এনার্জি পলিসি নিয়ে এসেছে। এখন তারা এক্টিভ হবে এবং পারমিট নেবে। জনৈক বিশেষজ্ঞ মহিউদ্দিন মোহাম্মদ বলেছেন, উনার উগান্ডার বন্ধু কয়েক দিনের মধ্যেই এদের সঙ্গে চুক্তি করে ছবি দেবে। অপেক্ষায় রইলাম। উনি বলেছেন, ট্রাম্পের লোম ও নাকি জানে না এই চুক্তির কথা। আমি ট্রাম্পের লোম বিশ্লেষণ করার মতো কাছাকাছি যাইনি। ইচ্ছাও নাই। কিন্তু এতটুকু বলতে পারি, প্লিজ ওয়েট এন্ড ওয়াচ।
আশিক চৌধুরী আরও বলেন, ‘উনি (মহিউদ্দিন) এটাও বলেছেন, আর্জেন্ট আমাদের এই চুক্তি দেখিয়ে লোন নেবে। উনি সম্ভবত ব্যাংক কিভাবে প্রজেক্ট ফাইন্যান্স করে, সেটা এক্সপেরিয়েন্স করেননি। প্রথমত, আর্জেন্টের প্রজেক্টের খুব কম অংশ আমরা অফটেক করতে পারব। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশের ক্রেডিট রেটিংও খুব ভালো না। সুতরাং আমাদের এই এইচও এ দেখিয়ে লোন নেবে, এসব লজিক দেবার আগে একটু সংশ্লিষ্ট প্রফেশনালদের সাথে কথা বললে ভালো হয়। আর আর্জেন্টের মতো আরো অনেক প্লেয়ার আছে আমেরিকান মার্কেটে। আমরাও ভবিষ্যতে হয়তো এ রকম অনেক কন্ট্রাক্ট সাইন করব। যেহেতু নন বাইন্ডিং, তাই আমরা সামনে সেরাটাকে বেছে নেব।’
‘এই বিষয়ে আর পোস্ট হয়তো দেওয়ার সুযোগ হবে না। Confidentiality আর লিগ্যাল অবলিগেশন অ্যাডহিয়ার করে যতটা সম্ভব, ম্যাক্সিমাম প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’
সমালোচনা মেনে নেবেন জানিয়ে বিডার চেয়ারম্যান বলেন, ‘পার্সোনাল অ্যাটাক এবং পেইড smear campaign-এর কোনো রেসপন্স করা হবে না। কমেন্ট বক্স ওপেন আছে ও থাকবে, ফিডব্যাক দিন, গঠনমূলক প্রশ্ন ও সমলোচনা করুন।’
মন্তব্য করুন