আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে দেশের ব্যাংক, জ্বালানি, ভৌত অবকাঠামো ও আইসিটি খাতে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত কমিটির অর্থনীতির শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, গত দেড় দশকে ২৮ উপায়ে লুটপাট করা অর্থের ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার করা হয়েছে দেশের বাইরে। এসব অর্থ ফেরত আনার লক্ষ্য নিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে সরকার। এ কাজে মূল নেতৃত্ব দেবে যে সংস্থাটি, সেই ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান হিসেবে কাকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন জটিলতা। গুরুত্বপূর্ণ এ সংস্থার প্রধান হতে আগ্রহীদের মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ১১ ও ১২ ডিসেম্বর। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া বেশিরভাগ ব্যক্তির বিরুদ্ধেই রয়েছে নানা অভিযোগ। এমনকি দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের দায়ে অভিযুক্ত এবং সমালোচিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের সুবিধাভোগী একাধিক কর্মকর্তাও রয়েছেন পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের তালিকায়। বিতর্কিত এসব কর্মকর্তার বিএফআইইউর প্রধান বানানো হলে পাচার অর্থ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য কতটা পূরণ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাসহ ১০ জন। তারা হলেন–বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এএফএম শাহীনুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম, জহুরুল হুদা, আকতারুল ইসলাম ও নুরুল আমিন; বর্তমান নির্বাহী পরিচালকদের মধ্যে রয়েছেন রফিকুল ইসলাম, একেএম এহসান, মামুন হোসেন ও মো. সাইফুল ইসলাম খান এবং এনসিসি ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি আশিকুর রহমান। এই ১০ জনের মধ্য থেকে সার্চ কমিটির পরামর্শে একজনকে বিএফআইইউ প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে জহুরুল হুদার বিরুদ্ধে এস আলম থেকে বিভিন্ন সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক থাকাকালীন এস আলম গ্রুপকে বিভিন্ন অবৈধ সুবিধা দিয়েছেন। এর প্রতিদান হিসেবে সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর এস আলমের মালিকানাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ট্রেনিং একাডেমির প্রিন্সিপাল হিসেবে চাকরি পান জহুরুল। পরে এস আলম গ্রুপ ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড (এনবিএল) দখল করার পর জহুরুলকে এই ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক করা হয়।
এস আলমকে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধেও। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্বাহী পরিচালক বিগত সরকারের আমলে বিএফআইইউর উপপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের তৎকালীন প্রধান আরেক বিতর্কিত মাসুদ বিশ্বাসের সব অপকর্মে ডান হাত হিসেবে সংগত জুগিয়েছেন রফিকুল। ছাত্রজীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন বলেও দাপট দেখাতেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশব্যাপী দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হলেও দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি রফিকুল। এজন্য তাকে বিএফআইইউ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। উপপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার কয়েক দিনের ব্যবধানে একই কর্মকর্তা ওই সংস্থার প্রধান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আলোচনায় উঠে আসার বিষয়টি বিস্মিত করেছে আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টদের।
আলোচিত প্রার্থীদের মধ্যে নজরুল ইসলামও বিএফআইইউর উপপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। তার বিরুদ্ধেও এস আলমের ব্যাংক লুটে সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে। এরই পুরস্কার হিসেবে তাকে এস আলমের দখল করা ইসলামী ব্যাংকের ট্রেনিং একাডেমির প্রিন্সিপাল করা হয়েছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাকে সেই পদ থেকে অপসারণ করেছে ইসলামী ব্যাংকের নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ।
মৌখিক পরীক্ষায় ডাক পাওয়া আরেকজন এনসিসি ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ডিএমডি) আশিকুর রহমান। তিনি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) বিতর্কিত সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াতের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। পুঁজিবাজারের অস্থিরতা সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে আশিকুরের নামে।
এনসিসি ব্যাংকের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা জানান, দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাংক ঋণ দেওয়ায় ডিএমডি পদ থেকে আশিকুরকে অপসারণ করা হয়েছিল। পরে শিবলী রুবাইয়াতের মাধ্যমে মাসিক ৮ লাখ টাকা বেতনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চিফ রেগুলেটরি অফিসার (সিআরও) পদে নিয়োগ পান আশিকুর। ডিএসইর নীতিমালা অনুযায়ী, সিআরও পদে নিয়োগপ্রাপ্ত কেউ পুঁজিবাজারে লেনদেন করতে পারবেন না। কিন্তু আশিকুর সেই নীতিমালার ধার ধারেননি। পুঁজিবাজারে ছিল তার বিপুল বিনিয়োগ। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে সিআরও পদ থেকে অপসারণ করা হয়। দুটি পদ থেকে অনিয়মের দায়ে অপসারিত ব্যক্তির নাম বিএফআইইউর সম্ভাব্য প্রধানের তালিকায় উঠে আসায় উদ্বেগ বেড়েছে সংশ্লিষ্টদের।
দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিএফআইইউ প্রধান নিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৩১ সেপ্টেম্বর প্রচারিত বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারের অর্থ বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান-সংক্রান্ত কার্যক্রমে কমপক্ষে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতাসহ প্রশাসনিক কার্যক্রম বা বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমে কমপক্ষে ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু আশিকুর বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কখনো কাজ করেননি। অর্থাৎ বিএফআইইউ প্রধান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতাই নেই তার। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাথমিকভাবে বিএফআইইউ প্রধান হিসেবে সম্ভাব্য যে ২০ প্রার্থীর তালিকা করা হয়েছিল, তাতেও আশিকুরের নাম ছিল না। এরপরও তিনি ডাক পেয়েছেন মৌখিক পরীক্ষায়। এর পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক একজন ডেপুটি গভর্নর কলকাঠি নেড়েছেন বলে জানা গেছে।
মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া আখতারুল ইসলামের বিরুদ্ধে ইউসিবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এবং সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাভেদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগ রয়েছে। ২০২১-২২ সালে বিএফআইইউর উপপ্রধানের দায়িত্ব পালনকালে আখতারুল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম ও সাইফুজ্জামান জাভেদকে বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা দিয়েছেন। সাইফুজ্জামান জাভেদকে আইএফআইসি ব্যাংক থেকে অনৈতিকভাবে ঋণ বের করে দিতেও আখতারুল সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া অন্য প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অনিয়মের তেমন কোনো অভিযোগ না থাকলেও তাদের মধ্যে দুজন সবেমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন।
আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ। তবে অনিয়মে জড়িত ব্যক্তিরা বিএফআইইউর মতো একটি স্পর্শকাতর সংস্থার প্রধানের পদে আলোচনায় উঠে আসায় বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিত সবাই। কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, বিএফআইইউ প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে একজন সৎ, যোগ্য ও চৌকস কর্মকর্তাকে। যিনি নির্মোহভাবে এবং দক্ষতার সঙ্গে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরাতে কাজ করবেন। কিন্তু পাচারকারীদের সহযোগীরাই যদি নিয়োগ পান, তাহলে সরকারের সদিচ্ছা মুখ থুবড়ে পড়বে। পাচার হওয়া অর্থ তো ফেরত আসবেই না, বরং আর্থিক খাত আবারও অনিয়মের চক্রে আটকে যাবে।
মন্তব্য করুন