আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের সময় জলবায়ু খাতে দেশের মানুষের মাথাপিচু কোনো ঋণ ছিল না। কিন্তু ২০২২ সালে এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৯.৬১ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় ৯ হাজার ৪৮৫ টাকা। অর্থাৎ ১৩ বছরে জলবায়ু খাতে মানুষের মাথাপিচু ঋণের বোঝা বেড়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ (সিআই) প্রকাশিত ‘জলবায়ু অর্থায়নে ন্যায়বিচার ও সমতা : বাংলাদেশ এবং অন্যান্য এলডিসির জন্য জলবায়ু ঋণের ফাঁদের ঝুঁকি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
রোববার (২০ অক্টোবর) রাজধানীর সিরডাপ সিআইসিসি ভেন্যুতে আয়োজিত জাতীয় সংলাপে সংস্থাটির এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
এ সময় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি আয়কারী চামড়া খাত বুড়িগঙ্গা এবং ধলেশ্বরী নদীর কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি করেছে তার পরিমাণ জানতে চেয়েছেন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। পাশাপাশি ব্যাংক থেকে তাদের কী পরিমাণ খেলাপি ঋণ রয়েছে সেই বিষয়ে জানতে চেয়েছেন তিনি।
উপদেষ্টা বলেন, আমাদের দেশের মানুষের বিস্তর ধৈর্য। তা না হলে ট্যানারিশিল্প কেরানীগঞ্জ থেকে পুরান ঢাকা এবং সেখান থেকে সাভারে স্থানান্তরিত করার পর পরিবেশের এত ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও তারা ধৈর্য ধরে আছেন। শুধু ব্যবসায়িক চিন্তা নয়, নিজেদের দেশের সম্পদ নিজেদেরকে রক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, জলবায়ুর সংকট নিরসনে বিদেশি ফান্ড কিভাবে আসছে সেটা নির্ণয় করা দরকার। সেটা অনুদান না কি ঋণ হিসেবে আসছে সেটার আলোচনা অবশ্যই করতে হবে। শুধু ঋণ নিতে থাকলে জলবায়ু সংকট নিরসনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে। কিন্তু উন্নত দেশগুলো বা আল্ট্রা ক্যাপিটালিস্ট এই পৃথিবীতে কতটা সম্ভব সেটাও বিবেচনায় আনতে হবে। জলবায়ু অর্থায়নে ন্যায়বিচার এবং সমতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শুধু তহবিল প্রদান যথেষ্ট নয়; আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে সম্পদ সবচেয়ে দুর্বল সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছায় এবং তাদের জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা গড়ে তোলার ক্ষমতা দেয়।
উপদেষ্টা বলেন, একটি অতি-পুঁজিবাদী মডেল সহজাতভাবেই প্রকৃত জলবায়ু ন্যায়বিচার এবং সমতাকে বাধাগ্রস্ত করা। আমাদের এই ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত স্বার্থের দ্বন্দ্ব গভীরভাবে পরীক্ষা করতে হবে এবং লাভের চেয়ে দুর্বলদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া বিকল্প পন্থা অন্বেষণ করতে হবে। তরুণরা যথার্থভাবেই জলবায়ু ন্যায়বিচার দাবি করছে। আমাদের তাদের এমনভাবে ক্ষমতায়িত করতে হবে, যাতে তারা কর্পোরেট ফাঁদে না পড়ে এবং জলবায়ু সহনশীল ভবিষ্যত গড়ার জন্য প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানের প্রবর্তক হয়ে উঠতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এ যাবৎ কাল পর্যন্ত জলবায়ু খাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জমা করেছে ১৪৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন খাতে ১৪ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহণ করেছেন, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৭ শতাংশ।
সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশ এবং অন্যান্য অনুন্নত দেশগুলি (এলডিসি) জলবায়ু ঋণের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ঋণ-ভিত্তিক জলবায়ু অর্থায়নের উপর নির্ভরতার ঝুঁকি তুলে ধরা হয়, যা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলিকে ঋণের বোঝা চাপিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করবে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের বহুপাক্ষিক মাথাপিছু জলবায়ু ঋণ ২ দশমিক শূন্য ৪ ডলার। অন্যান্য জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ এলডিসি-র গড়ের চেয়ে তিনগুণ বেশি। এই খাতের গড় শূন্য দশমিক ৮৫ ডলার। প্রতিশ্রুত আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিলের মাত্র ৩০ দশমিক ৭৪ শতাংশ এলডিসিতে বিতরণ করা হয়েছে, যার ফলে অভিযোজন এবং প্রশমন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য নিতান্ত অপ্রতুল।
এ সময় চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের নির্বাহী পরিচালক এম জাকির হোসেন খান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যাকে ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ করা সম্ভব নয়। এই পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, গাইবান্ধার কৃষকের ওপর যেমন, ভারতের আসাম-ত্রিপুরা-রাজস্থানের কৃষকের জন্যও একই। তাই এই পরিবর্তন মোকাবিলায় ক্ষুদ্র স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে বৃহত্তর স্বার্থে প্রাকৃতিক অধিকার সুরক্ষায় টেকসই পদক্ষেপ জরুরি।
মন্তব্য করুন