
দিনাজপুর কোতোয়ালি থানায় হাজির শহরের নতুন ঘাসিপাড়া এলাকার বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা ১০ মিনিটে পুলিশকে জানান, নিজ ফ্ল্যাটে স্ত্রী সুমাইয়া আক্তার হাসিকে হত্যা করে রেখে এসেছেন। তার কথামতো পুলিশ ফ্ল্যাটে গিয়ে সুমাইয়ার মরদেহ উদ্ধার করে।
পরে পুলিশের জিজ্ঞসাবাদে তিনি পারিবারিক কলহের কারণে শুক্রবার ভোরে স্ত্রীকে হত্যা করে ঘরের ওয়ার্ডরোবের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখে বলে জানান। ভালোবেসে বিয়ে করার মাত্র ২৮ দিনের মাথায় নিজের স্ত্রীকে শ্বাসরোধ করে হত্যার ঘটনায় শহরে আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দেয়। পর দিন ১৮ ফেব্রুয়ারি নিহত গৃহবধূ হাসির বড় ভাই ইছাহাক আলী মনোয়ার হোসেনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।
উত্তরের এই জেলায় সম্প্রতি পারিবারিক কলহ বেড়ে গেছে। এ কারণে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে। পারিবারিক কলহের শিকার হচ্ছে শিশুরাও। অনেকে বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ।
দিনাজপুর নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের হিসাব অনুযায়ী, জেলায় ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১ হাজার ৬৩৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৩৭৫ ও চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ২৬১টি মামলা হয়েছে।
অপরদিকে দিনাজপুর জেলা রেজিস্ট্রার অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে জেলায় প্রায় ১৫ হাজার বিয়ে হয়েছে। একই সময়ে তালাক হয়েছে প্রায় ৭ হাজার। এর আগে ২০২১ সালে মোট বিয়ে হয়েছিল ১৬ হাজার। ওই সময় তালাকের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার।
চলতি বছরের প্রথম দিন, অর্থাৎ ১ জানুয়ারি সকালে খানসামা উপজেলার ভাবকী ইউনিয়নের মারগাঁও হাজিপাড়া থেকে ওই এলাকার আব্দুর রহিমের ছেলে রবিউল ইসলাম (৩৫) ও তার স্ত্রী সামছুন নাহারের (৩২) ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ২০২২ সালের ২৫ নভেম্বর জেলার বিরল উপজেলার ভবানীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে ৭ বছরের শিশু ইমরান ও ৩ বছরের শিশু রিমনের মরদেহ উদ্ধার করে থানা পুলিশ। সম্পর্কে দুই শিশু সহোদর। একই সন্ধ্যায় বিরল উপজেলার মঙ্গলপুর বাজার থেকে নিহত দুই শিশুর বাবা শরিফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রাতে নিহত দুই শিশুর মা কুলসুম বানু স্বামী শরিফুল ইসলামকে আসামি করে মামলা করেন। পরে পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারে শরিফুল ও কুলসুমের পারিবারিক কলহের কারণেই এই হত্যার ঘটনা ঘটে।
২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর দিনাজপুরের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ যাবিদ হোসেন এক হত্যা মামলায় গৃহবধূ সাদিয়া আক্তার আশাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন। আশা পার্বতীপুর উপজেলার হরিরামপুর (ভাটিপাড়া) এলাকার এরশাদ আলীর স্ত্রী। ছয় বছরের শিশুকন্যা মাইমুনা আক্তারকে হত্যার দায়ে বিচারক তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন।
পার্বতীপুর উপজেলার ৫ নম্বর চণ্ডীপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ শালন্দাপুর (স্কুলপাড়া) এলাকায় দেলোয়ার হোসেন ও স্ত্রী জাকিয়া খাতুনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক কলহ চলছিল। ২০২২ সালের ২৩ নভেম্বর বুধবার ভোরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। ওই সময় জাকিয়াকে দেলোয়ার ঘুষি মারেন। কিন্তু সেই ঘুষি জাকিয়ার গায়ে না লেগে ৫ বছরের শিশুসন্তানের লাগে। এতে ঘটনাস্থলেই শিশু জাকারিয়ার মৃত্যু হয়।
দিনাজপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তৈয়বা বেগম বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে যেসব মামলা আসে সেগুলোর মধ্যে অর্ধেকই পারিবারিক কলহের কারণে হত্যা, নির্যাতন কিংবা আত্মহত্যার প্ররোচনার মতো থাকে। আর পারিবারিক কলহের কারণে হওয়া মামলার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব ঘটনা প্রতিরোধে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।’
পারিবারিক কলহ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসাবে সচেতনতার অভাবকে দায়ী করলেন মহিলা পরিষদের সভাপতি কানিজ রহমান। তিনি বলেন, ‘পারিবারিক কলহ নিরোধ করতে দেশের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের মধ্যে সচেতনতার সৃষ্টি করতে হবে।’