ডাকসাইটে তারকা ক্রীড়া সাংবাদিক মোস্তফা মামুনের নির্বাচিত সেরা ১০টি গল্প নিয়ে অন্যপ্রকাশ প্রকাশ করেছে তার সেরা ১০ গল্প। আমি মোস্তফা মামুনকে বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য শক্তিশালী গল্পকার মনে করি। আমি এর জন্য বাজি ধরতে রাজি যে, এ সময়খণ্ডের ‘লোকে নাম পরিচয় জানে’ এমন অনেক লেখকেরও এমন দশটি ভালো গল্প নেই। তার গল্পের বড় শক্তির জায়গাটা হলো ভাষাভঙ্গি। অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় আড্ডায় গল্প বলবার মতো করে চিত্ররূপময় বর্ণনায় গল্পগুলো বলা। পাঠকের মনে হবে সে সামনে ঘটনাগুলো ঘটতে দেখছে। এইখানে বঙ্কিমের তথাকথিত প্রাঞ্জলতা অর্জন করেছেন ছোটগল্পকার মোস্তফা মামুন, দশটি গল্পেরই প্রথম সফলতা হলো প্রায় প্রথম বাক্যেই পাঠককে হুক করে ফেলা। দিশাহারা করে ফেলা এমনভাবে যে, এরপর আর গল্পগুলো শেষ না করে উপায় থাকবে না বেচারা পাঠকের। আর শেষ করলেই সে পড়বে একটা তীব্র প্রশ্নফাঁদে, এই লেখককে কেন আমি এতদিন পড়িনি?
মোস্তফা মামুনের রচনার এক বড় গুণ তার রসবোধ, এই গল্পগুলোতে প্রাঞ্জল বর্ণনার মধ্যে একটু পরপরই হাসতে বাধ্য হবেন পাঠক আর হাসি পেলে সে ঘটনা কীভাবেবা ভুলবে কেউ! মোস্তফা মামুন তার রচনার শিল্পকৌশলের মধ্যে এ ব্যাপারটাকে এমনভাবে প্রোথিত করেছেন যে, পাঠক হাসতে হাসতে নির্মম বাস্তবতা বা অনপেক্ষ জীবন দর্শনের গোলকধাঁধায় পড়ে যাবেন।
ভালো কোচ যেমন তার কৌশল বুঝতে পারার আগেই প্রতিপক্ষের জালে কয়েক গোল করিয়ে ফেলেন দলকে, ভালো ব্যাটসম্যান যেমন প্রতিপক্ষকে বুঝতে না দিয়েই সিঙ্গেলস নিয়ে সেট হয়ে যান পিচে তেমনি ভালো লেখক তিনি যিনি পাঠককে বুঝতেই দেন না তার কৌশল বা টেকনিক। বড় বড় সাহিত্য সমালোচক বহু বছর ধরে বলছেন, ভালো গল্পকার তিনিই, যার কৌশল পাঠক ধরতে পারেন না, কৌশল ধরতে পারার আগেই গল্প শেষ হয়ে যায় আর পাঠক স্তম্ভিত হয়ে স্থানু এক স্ট্যাচু হয়ে যান।
আমি মোস্তফা মামুনের যে গল্পগুলো পড়ে মুগ্ধ হয়েছি তার মধ্যে প্রথম স্থান দখল করতে পারত এই দশটির আসলে যে কোনোটিই। কিন্তু পাঠকের মন বড়ই কুমারীকিশোরীসম, কখন যে কাকে কোন পরিস্থিতিতে ভালো লাগে বোঝা দুষ্কর। প্রথম পজিশনের জন্য সালাম, পলাতক বীর আর পিস্তল হাতে পাওনাদারের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে আমার মনে। কী কী বিবেচনায় লিখতে পারলে লেখাটা আরও ভালো হতো কিন্তু দীর্ঘ আয়তন হয়ে যাবে বলে এ প্রসঙ্গ অন্য লেখার জন্য তুলে রাখছি।
যেহেতু নাম্বারিং এক দিক থেকে শুরু করতে হয়, প্রথম গল্পটা তাই, মোস্তফা মামুনের গল্পসমগ্রেরও প্রথম গল্প, যার নাম ‘পলাতক বীর’। একজন খাঁটি মানুষের পালিয়ে বেড়ানোর গল্প। জীবনে টিকে থাকতে হলে কত কৌশলই না করতে হয় মানুষকে, কত লড়াই করতে হয় মূল্যবোধের সঙ্গে! পেটে ভাত নাই, তবু মূল্যবোধ, ঘরে খিদে পেট, পরিবারে সম্মান নাই তবু মূল্যবোধ-মূল্যবোধ যে মানুষকে অমানুষ হওয়া থেকে বাঁচায় আর মানুষ থাকতে পারা যে কত আনন্দের এই দার্শনিক প্রশ্নের সামনে পাঠককে ফেলে দেয় এই গল্প। প্রচণ্ড সিনেম্যাটিক, চিত্রকল্পময় বর্ণনা, মোস্তফা মামুনের স্বভাবজাত উইট আর প্রাঞ্জলতা গল্পটাকে ধ্রুপদী মাত্রা দিয়েছে, যা অবশ্যম্ভাবীভাবেই পাঠকের মনে দাগ কাটবে। এই গল্প ভুলতে পারবে না যে পড়বে সেই, সেখানে খুঁজে পাবে পাঠক নিজেকে, নিজের জীবনের স্ট্রাগলের কথাই থেকে থেকে মনে পড়বে তার। একটা পিস্তল থাকা সত্ত্বেও একটা ভাড়াটে খুনির কাজ- নাহ, স্পয়লার না দিই আর, সবাই বরং পড়ুক গল্পটা।
তালিকার দ্বিতীয় গল্পটার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে পিস্তল। এমনকি এর শিরোনামই ‘পিস্তল হাতে পাওনাদার’। আদতে গল্প শেষ করে স্তম্ভিত পাঠকের মনে হবে গল্পটার নাম হওয়া উচিত ছিল ‘সেকেন্ড ম্যান’। এ এক সেকেন্ডম্যানের গল্প, কৃতজ্ঞ সেকেন্ডম্যান এই গল্পের মূল চরিত্র, প্লটটাও দারুণ মুনশিয়ানায় সাজিয়েছেন মোস্তফা মামুন। যে কোনো পাঠকের এ গল্প পড়ে মনে হবে, আহা আমি যদি হতে পারতাম মোস্তফা মামুনের গল্পের সেকেন্ড ম্যানের মতো ক্ষমতাধর, যে ফার্স্ট ম্যানের জীবন থেকে দুঃসহ স্বপ্ন পর্যন্ত দক্ষতা ও কৌশলে মুছে দিতে পারে! বস্তু ও ব্যক্তির দ্বন্দ্ব-সংঘাতের দোলাচলে তাই পাঠক একবার পড়লে এ গল্প কখনো ভুলতে পারবে না।
তৃতীয় গল্পটা সালাম, ক্রসফায়ার না প্রেম! গল্প পড়া শেষ করে বিমূঢ় পাঠক ঠিক করতে পারে না গল্পটা ক্রসফায়ারের না প্রেমের! মানবিকতার না পাশবিকতার। নাকি মানবিকতা আর পাশবিকতার মাঝখানে যে ধূসররেখা তার জয়গানের। এই গল্প প্রচণ্ডভাবে রাজনৈতিক, এই গল্প পড়ে পাঠক খোঁজ করবে আদতে মোস্তফা মামুন কখনো বামপন্থি ছিলেন কি না, কিংবা মোস্তফা মামুন এভাবে প্রেমের জয়গান কীভাবে লিখলেন!
বাকি ৭টি গল্প নিয়েও এমন অনেক ভালো ভালো কথা বলা যাবে, এমন মনে দাগ কেটে যাবে সেসব গল্প। করণকৌশল, দৃশ্যকল্প আর টুইস্ট পাঠককে তাড়িয়ে বেড়াবে বহু বহু দিন। এই দশটা গল্প পড়লে আমার মতোই মোস্তফা মামুনের গল্প নিয়ে উচ্চধারণা তৈরি হবে যে কোনো প্রস্তুত পাঠকের- আমার কোনো কথাকেও আর বাড়িয়ে বলা মনে হবে না।
সাহিত্য রচিত হয় মানুষের জন্য। মানুষের জীবন তাতে প্রতিফলিত হয়। মানুষের জন্যই সাহিত্য এবং মানুষের জীবন নিয়েই তার সৃষ্টি, কিন্তু সাহিত্য কেবল জীবনকে চিত্রিতই করে না, জীবনকে বুঝতেও সাহায্য করে। মোস্তফা মামুনের বড় কৃতিত্ব তার এ দশটি গল্পই মানুষকে বুঝতে সাহায্য করে, জীবনকে বুঝতে সাহায্য করে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন
লেখক, কবি ও সাহিত্য সম্পাদক, দেশ রূপান্তর
মন্তব্য করুন