মহান ভাষা আন্দোলন ও অমর একুশের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রতিবছরের মতো এবারও বাংলা একাডেমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজন করতে যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলা-২০২৫। আগামী ১লা ফেব্রুয়ারি এ মেলার উদ্বোধন করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস। জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাতি গঠনের লক্ষ্যে এবারের বইমেলার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান : নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’। এবারের মেলায় ৭০৮টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মোট ১০৮৪টি ইউনিটে অংশ নিতে যাচ্ছে, যেখানে গত বছর প্রতিষ্ঠান ছিল ৬৪২টি এবং ইউনিট ছিল ১৯৪৬টি।
বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) সকাল ১১টায় বাংলা একাডেমির আব্দুল করীম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে মেলা উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন অমর একুশে বইমেলা-২০২৫ পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব সরকার আমিন।
লিখিত বক্তব্যে সরকার আমিন বলেন, মহান ভাষা আন্দোলনের অমর শহিদের স্মৃতিতে আগামী ১লা ফেব্রুয়ারি শুরু হতে যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলা ২০২৫। আমরা ভাষা শহীদ-ভাষাসংগ্রামী, মুক্তিযুদ্ধ, গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২৪-এর শহীদ, আহত ও অংশগ্রহণকারী সকলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। এবারের বইমেলার মূল প্রতিপাদ্য ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’। আগামী ১লা ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টায় বইমেলা উদ্বোধন করবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জ্ঞানভিত্তিক, মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে বই এবং বইমেলা সহায়ক। আমরা আশা করি সকল সম্ভাবনায় আলোকিত হবে এবারের মেলা- আমাদের প্রাণের বইমেলা।
তিনি বলেন, এবার বইমেলার বিন্যাস গতবারের মতো অক্ষুন্ণ রাখা হয়েছে তবে কিছু আঙ্গিকগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশেষ করে, মেট্রোরেল স্টেশন-এর অবস্থানগত কারণে গতবারের মেলার বাহির-পথ এবার একটু সরিয়ে মন্দির-গেটের কাছাকাছি স্থানান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া টিএসসি, দোয়েল চত্বর, এমআরটি বেসিং প্লান্ট এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন অংশে মোট ৪টি প্রবেশ ও বাহির-পথ থাকবে। খাবারের স্টলগুলো ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনের সীমানা-ঘেঁষে বিন্যস্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, খাবারের স্টলগুলোকে এবার বিশেষভাবে সুবিন্যস্ত করা হয়েছে। নামাজের স্থান, ওয়াশরুমসহ অন্যান্য পরিষেবা অব্যাহত থাকবে।
তিনি জানান, শিশুচত্বর মন্দির-গেটে প্রবেশের ঠিক ডান দিকে বড়ো পরিসরে রাখা হয়েছে, যেন শিশুরা অবাধে বিচরণ করতে পারে এবং তাদের কাঙ্ক্ষিত বই সহজে সংগ্রহ করতে পারে। বইমেলায় বাংলা একাডেমি এবং মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করবে। প্রতিদিন বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে সেমিনার এবং সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বাংলা একাডেমির ৩টি প্যাভিলিয়ন এবং শিশু-কিশোর উপযোগী প্রকাশনার বিপণনের জন্য ১টি স্টল থাকবে। ৮ই ফেব্রুয়ারি ও ১৫ই ফেব্রুয়ারি ব্যতীত প্রতি শুক্র ও শনিবার মেলায় সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত ‘শিশুপ্রহর’ থাকবে। অমর একুশে উদযাপনের অংশ হিসেবে শিশুকিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি এবং সংগীত প্রতিযোগিতার আয়োজন থাকছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকবে।
সরকার আমিন জানান, বইমেলার প্রবেশ ও বাহিরপথে পর্যাপ্ত সংখ্যক আর্চওয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাব, আনসার ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য মেলায় এলাকাজুড়ে তিন শতাধিক ক্লোজসার্কিট ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বইমেলা পলিথিন ও ধূমপানমুক্ত থাকবে। মেলাপ্রাঙ্গণ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় (সমগ্র মেলাপ্রাঙ্গণ ও দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসি হয়ে শাহবাগ, মৎস্য ভবন, ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউট হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত এবং দোয়েল চত্বর থেকে শহীদ মিনার হয়ে টিএসসি, দোয়েল চত্বর থেকে চাঁনখারপুল, টিএসসি থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত) নিরাপত্তার স্বার্থে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকবে। মেলার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং নিয়মিত ধূলা নিবারণের জন্য পানি ছিটানো এবং প্রতিদিন মশক নিধনের সার্বিক ব্যবস্থা থাকবে।
বিভিন্ন পুরস্কারের ব্যাপারে জানিয়ে মেলার সদস্য সচিব আরও বলেন, অমর একুশে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ২০২৪ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগতমান বিচারে সেরা বইয়ের জন্য প্রকাশককে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’ এবং ২০২৪ সালের বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের মধ্য থেকে শৈল্পিক বিচারে সেরা বই প্রকাশের জন্য ৩টি প্রতিষ্ঠানকে ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হবে। এ ছাড়া ২০২৪ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগত মান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থের জন্য ১টি প্রতিষ্ঠানকে ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’ এবং এ-বছরের মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে স্টলের নান্দনিক সাজসজ্জায় শ্রেষ্ঠ বিবেচিত প্রতিষ্ঠানকে ‘কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করা হবে। এবারের বইমেলা বাংলা একাডেমি প্রকাশ করছে নতুন ৪৩টি ও পুনর্মুদ্রিত ৪১টি বই।
লিখিত বক্তব্য শেষে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ও সদস্য সচিব সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। এসময় বইমেলায় বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সম্পর্কিত বই নিয়ে মব সংস্কৃতির আশঙ্কা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, মবের আশঙ্কা কে না করে? বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধে আমাদের প্রস্তুতি আছে কিনা, সে প্রশ্ন করতে পারেন। আমাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি আছে। মিটিংয়ের পর মিটিং করে আমাদের সিকিউরিটি ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। দেশ-জাতি-নীতিবিরুদ্ধ কোনো বই প্রদর্শিত হলে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার বাংলা একাডেমি রাখে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বই প্রদর্শন করতে কোনো বাধা নেই। সেক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা হলে বাংলা একাডেমি সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্বে পড়ে না। আমরা পুলিশ ফোর্স নই। কোনো বিশৃঙ্খলা হলে বাংলা একাডেমি সংশ্লিষ্ট আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে যারা আছেন তাদের অবগত করবেন।
স্টলসংক্রান্ত তথ্য : এবারের বইমেলায় মোট প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ৭০৮টি, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ১৯৯টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৬০৯টি; মোট ইউনিট ১০৮৪টি (গত বছর প্রতিষ্ঠান ছিল ৬৪২টি এবং ইউনিট ছিল ১৯৪৬টি)। এবার মোট প্যাভিলিয়নের সংখ্যা ৩৭টি, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ০১টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩৬টি; (গত বছর প্যাভিলিয়নের সংখ্যা ছিল ৩৭টি)। লিটল ম্যাগাজিন চত্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চের কাছাকাছি গাছতলায়। সেখানে প্রায় ১৩০টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শিশুচত্বরে মোট প্রতিষ্ঠান ৭৪টি এবং ইউনিট ১২০টি (গত বছর প্রতিষ্ঠান ছিল ৬৮টি এবং ইউনিট ১০৯টি)।
বইমেলার সময়সূচি : ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। রাত সাড়ে ৮টার পর নতুন করে কেউ মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারবেন না। ছুটির দিন বইমেলা চলবে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত (৮ই ফেব্রুয়ারি ও ১৫ই ফেব্রুয়ারি ব্যতীত)। ২১শে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মেলা শুরু হবে সকাল ৮টা এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।
মেলা হবে পলিথিনমুক্ত : এবারের অমর একুশে বইমেলার আয়োজনকে পরিবেশ সুরক্ষা সচেতন এবং জিরো ওয়েস্ট বইমেলায় পরিণত করার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। এই লক্ষ্যে আয়োজনস্থল ও পাশ্ববর্তী এলাকায় স্থাপিতব্য সব স্টল, দোকান, মঞ্চ, ব্যানার, লিফলেট, প্রচারপত্র, ফাস্ট ফুড, কফি শপ, খাবার দোকান ইত্যাদি প্রস্তুতে সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার শতভাগ পরিহার করে পুনঃব্যবহারযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব উপকরণ যেমন- পাট, কাপড়, কাগজ ইত্যাদির ব্যবহার করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
মন্তব্য করুন