প্রতি বছরের ন্যায় এবারও কালি ও কলম কবি, প্রাবন্ধিক ও ‘কালি ও কলম’ সম্পাদক আবুল হাসনাতের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করেছে। শুক্রবার (১ নভেম্বর) বিকেল ৫টায় ‘কালি ও কলম’-এর আয়োজনে ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে আবুল হাসনাতের স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয়। ‘আবুল হাসনাত স্মারক বক্তৃতা’, ‘সাহিত্য ও গণমুক্তির সাধনা’ বিষয়ে মূল বক্তব্য প্রদান করেন প্রাবন্ধিক ও কবি আবুল মোমেন। আলোচনায় অংশ নেন লেখক ওয়াসি আহমেদ। সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। এ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন কালি ও কলম সম্পাদক সুব্রত বড়ুয়া।
আবুল মোমেন তার প্রবন্ধে বলেন, এদেশের সাহিত্যের পরিচর্যার পাশাপাশি প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। বিশেষত গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এবং একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে তিনি নানাভাবে অবদান রেখেছেন।
ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, হাসনাত ভাই অনেক মানুষকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছেন। সাহিত্যের গভীরে যে বিষয়গুলোর সংযোগ থাকে তা হাসনাত ভাই নিজের মাঝে ধারণ করতেন।
’৭১-এর পর আমাদের বিশ্বাস ছিল সাহিত্যের ধারা আরও বিকশিত হবে কিন্তু দুঃখের বিষয় আশানরূপ বিকাশ আমরা দেখতে পারিনি। সংস্কৃতির সেই বিস্তীর্ণপ্রবাহ আর ছিল না। এজন্যই এই আলোচনা চলে এসেছে যে সাহিত্য ও গণমুক্তির প্রবাহ কোন পথে যাচ্ছে। আবুল মোমেন এই প্রশ্ন ও আলাপ খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। গণমুক্তি শুধু রাজনৈতিক মুক্তি নয়, এটা মানুষের চিন্তার মুক্তি। আমাদের জ্ঞানমুক্তির tools বদলে গেছে। বই এর জায়গা দখল করেছে সোশ্যাল মিডিয়া। কিন্তু এসবের ভালো খারাপ নির্ণয় করার চিন্তা আমরা নিরপেক্ষভাবে করতে পারছি না। আমরা অনেক এককেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি যা একটি মননশীল সমাজ বা রাষ্ট্রের বিকাশের অন্তরায়। আমরা আশা করছি সংস্কৃতি ও শিক্ষাকে ভেতরে ধারণ করে, মুক্ত পরিবেশে একটি ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়ে উঠবে। এই স্বপ্ন প্রণয়নে আমরা কতদূর অবদান রাখতে পেরেছি তা জানিনা, কিন্তু হাসনাত ভাই এর মতো মানুষ আমৃত্যু এই উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে গেছেন।
২০২০ সালের এই দিনে ৭৫ বছর বয়সে আবুল হাসনাত মারা যান। আবুল হাসনাত ১৯৪৫ সালের ১৭ জুলাই পুরান ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। কবিতা, উপন্যাস, শিল্প সমালোচনাসহ সাহিত্যের নানা বিভাগে পদচিহ্ন রেখেছেন তিনি।
আবুল হাসনাত নামে বেশি পরিচিত হলেও তার প্রকৃত নাম ছিল মাহমুদ আল জামান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ছাত্রজীবনে তিনি বামপন্থী ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেও সক্রিয় ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রায় পুরোটা সময় পার্টির নির্দেশে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অবিচল লক্ষ্যে কলকাতায় থেকে কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে।
কর্মজীবনের শুরুতে তিনি যোগ দেন দৈনিক সংবাদে সহসম্পাদক হিসেবে। পরবর্তীকালে ‘সংবাদ সাময়িকী’র সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন দুই যুগেরও বেশি সময়। এসময়ে ‘সংবাদ সাময়িকী’ হয়ে ওঠে এ দেশের সাহিত্যের দর্পণ। অতঃপর সংবাদ ছেড়ে যোগ দেন ‘কালি ও কলম’ পত্রিকায়। তিনি চিত্রকলাবিষয়ক পত্রিকা ‘শিল্প ও শিল্পীর’ও সম্পাদক ছিলেন।
এ ছাড়া তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ‘গণসাহিত্য’ ও ‘প্রণোদনা’ সাহিত্য পত্রিকা। মৌলিক রচনা ও সম্পাদনাসহ তার ৭০টিরও বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৪ সালে তিনি মনোনীত হন বাংলা একাডেমির সম্মানসূচক ফেলো। এ দেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গেও ছিল তার নিবিড় সম্পর্ক, যুক্ত ছিলেন ছায়ানটসহ বহু সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে।
সম্পাদক হিসেবে তিনি নৈর্ব্যক্তিক আর কবি হিসেবে ছিলেন একান্ত ব্যক্তিগত। ষাটের দশক থেকে কবিতা লিখলেও নিজের লেখা প্রথম কবিতার বই প্রকাশ করেন আশির দশকে।
মন্তব্য করুন