লোকজ সুরের মূর্ছনায় ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রাখার প্রত্যয় নিয়ে প্রতিষ্ঠার ৫৬তম বার্ষিকী উদযাপন করলো দেশের অন্যতম প্রাচীন এবং বৃহত্তম এ সাংস্কৃতিক সংগঠন, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।
মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) বিকালে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজন করে বাউল ও মরমী গানের অনুষ্ঠান। ‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি’ শ্লোগান নিয়ে এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজনের শুরুতে জাতীয় পতাকা ও সংগঠনের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এসময় জাতীয় সঙ্গীত ও সংগঠন সঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা।
এরপর আয়োজনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন বাউল সাধক শফি মণ্ডল। উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমানের সভাপতিত্বে শুরু হয় আলোচনা পর্ব। আলোচনায় অংশ নেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে, স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে জীবন দেওয়া শিক্ষার্থী ফারহান ফাইয়াজের বাবা শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া এবং বোন সায়মা ইসলাম ফারিন। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন বাউল সাধক সাইদুর রহমান বয়াতি, উদীচীর সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা এবং ডা. লেলিন চৌধুরী।
ফাইয়াজের বাবা বলেন, ছেলে হারানো শোক কোনো কিছুতেই পূরণ হয় না। তবে তার ছেলেসহ শহিদদের পরিবার নিয়ে যেন কেউ রাজনীতি না করে সে আহ্বান জানান তিনি।
তিনি বলেন, নিহতদের স্বজনের একটাই আশা, আর তা হলো বাংলাদেশ যেন সত্যিকার অর্থে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
অন্য আলোচকরা বলেন, আবহমান বাংলার সংস্কৃতি হলো অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী সংস্কৃতি। এর বিরুদ্ধে গিয়ে কোন অপশক্তিই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধান রক্ষার প্রত্যয় জানান উদীচী সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান। গান শুধু বিনোদন না হয়ে সমাজ বদলের হাতিয়ার হয়ে ওঠে সে আহ্বানও জানান বক্তারা।
আলোচনা পর্বের পর শুরু হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা পর্ব। এ পর্বের শুরুতেই সমবেত নৃত্য পরিবেশন করেন উদীচীর নৃত্যশিল্পীরা। এরপর সমবেত আবৃত্তি পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন উদীচীর বাচিক শিল্পীরা। তাদের পর কয়েকটি বাউল ও লোক গান পরিবেশন করেন উদীচীর সঙ্গীত বিভাগের শিল্পীরা। লালন সাঁই, হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিম, রাধারমণ দত্তের জনপ্রিয় কিছু গান পরিবেশন করেন তারা। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন উদীচীর সহ-সভাপতি বেলায়েত হোসেন।
উদীচীর ৫৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি মাহমুদ সেলিম ও হাবিবুল আলম, সূর্য লাল দাশ, পূর্ণ চন্দ্র মন্ডল, কল্পনা খান, শাহিনুর আলামিন, অবিনাশ বাউল, আনান বাউল, ফতেহ আলী খান আকাশ প্রমূখ। এছাড়া, সমবেত পরিবেশনা উপস্থাপন করে উদীচী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ, গেন্ডারিয়া শাখা, ডেমরা শাখা ও রায়েরবাজার শাখার শিল্পীরা।
আয়োজনের শেষ ভাগে ছিল আমন্ত্রিত শিল্পীদের মনোজ্ঞ পরিবেশনা। একক গান পরিবেশন করেন প্রবীণ বাউল সাধক সাইদুর রহমান বয়াতী এবং অনুষ্ঠানের উদ্বোধক বাউল শফি মণ্ডল। এছাড়া কিছুদিন আগে হামলার শিকার ফরিদপুরের লালন আনন্দ ধামের পক্ষে শিল্পী জাহিদ হাসান। বাংলাদেশ বাউল ও লোকশিল্পী সংস্থার পরিবেশনা দিয়ে শেষ হয় উদীচীর ৫৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন। পুরো আয়োজনজুড়েই ছিল সাবেক ও বর্তমান উদীচী কর্মীদের মিলনমেলা।
নিপীড়িত মানুষের গান গাইবার অঙ্গীকার নিয়ে, মানুষের মুক্তির জন্য, সোচ্চার হওয়ার লক্ষ্যে একটি অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালানোর উদ্দেশ্যে ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। একটি রাজনৈতিক অঙ্গীকারসম্পন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে এরই মধ্যে দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে উদীচী।
মন্তব্য করুন