বাতাসে হিম হিম ছোঁয়ায় টের পাওয়া যাচ্ছে, এখন পূর্ণ শরৎকাল। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা আর প্রান্তরজুড়ে কাশের গুচ্ছ হৃদয়ে জাগায় প্রাণের স্পন্দন। কথা, কবিতা ও গানে সত্য ও সুন্দরের এ ঋতুর বন্দনা করলেন রাজধানীর শিল্পীরা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশজুড়ে এখনো যে সহিংসতা বিরাজমান, তার বিপরীতে শিল্পীরা গাইলেন সম্প্রীতির গান। প্রীতি-বন্ধনে মিলনের বার্তা ছড়িয়ে দিলেন নৃত্যশিল্পীরা।
শুক্রবার (৪ অক্টোবর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল শরৎ উৎসব।
শুদ্ধ-সুন্দর-শুভ্রতায় মঙ্গলের বার্তা আনার প্রত্যয়ে সকাল সাড়ে ৭টায় যন্ত্রসংগীতশিল্পী মো. ইউসুফ খানের সরোদ বাদনে শুরু হয় এ উৎসব। ততক্ষণে বকুলতলায় এসে হাজির হয়েছে একদল শিশু-কিশোর। পরনে নীলাভ শুভ্র বসন, কিশোরীরা কানে গুঁজেছেন কাঁঠালচাপা। শরতের আকাশে কালো মেঘের আনাগোনায় খুদে শিল্পীদের মুখাবয়বে তখন রাজ্যের আঁধার- এ বুঝি এলো বৃষ্টি! একপশলা দমকা বাতাস বয়ে গেলেও বৃষ্টি হয়নি। প্রাঙ্গণজুড়ে আসে স্বস্তি।
এ সময় সুরবিহারের শিল্পীরা শোনান ‘ওগো শেফালি বনে মনের কামনা’৷ সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা পরিবেশন করেন রবীন্দ্রসংগীত ‘দেখো দেখো শুকতারা আঁখি মেলে চায়’ এবং নজরুল সংগীত ‘এ কী অপরূপ রূপে মা তোমায়’ গান দুটি। সীমান্ত খেলাঘর আসরের শিশুরা পরিবেশন করে রবীন্দ্রনাথের ‘আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায়’ গানটি। শিল্পবৃত্তের শিশুরা পরিবেশন করে দলীয় আবৃত্তি প্রযোজনা ‘শরৎ রাণী’। দলীয় সংগীত পরিবেশনায় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী পরিবেশন করে ‘আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে’৷ নির্ঝরণী সংগীত একাডেমি পরিবেশন করে ‘এসো হে সজল শ্যামল ঘন দেয়া’৷ সমস্বরের শিল্পীরা শোনায় ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’।
উৎসবের ঘোষণাপত্রে বলা হয়, প্রকৃতির সঙ্গে মানবের মিলনে জীবনের আনন্দরস খুঁজে পাওয়ার চিরন্তন শারদীয় উৎসবে এবার মিশে আছে বেদনার সুর। সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট বলেন, আমরা সশ্রদ্ধভাবে স্মরণ করি নবপ্রভাতের স্বপ্নবহ ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে আত্মাহুতি-দানকারীদের, ব্যথিত চিত্তে লক্ষ্য করি ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা ও হিংসার বিস্তারে দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু। বৈষম্যহীন মুক্ত স্বাধীন সম্প্রীতির সমাজের স্বপ্নবহ আন্দোলন জীবনে নানাভাবে পল্লবিত হোক, সে প্রত্যাশাও মিশে থাকে শরৎ-আবাহনে।
শারদোৎসব মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির, জীবনের সঙ্গে মহাজীবনের, সমকালের সঙ্গে চিরকালের মেলবন্ধন রচনা করে বলে মন্তব্য করেন সুইট।
তিনি বলেন, বাংলার মাটির ও প্রকৃতির এমন উৎসব তাই নব-আনন্দে জেগে-ওঠার বাণীমন্ত্র যেমন শোনায়, তেমনি আমাদের দায়িত্ববান করে তোলে প্রকৃতি-সংহারী পদক্ষেপ প্রতিরোধে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে, সে সঙ্গে মানবসমাজ ও জীবনের চালচিত্রে বিভিন্নতার রঙ-রূপ-রস রক্ষা করে সম্প্রীতির জয়গান গাইতে। শরৎ উদযাপন হোক মানবিক মিলনোৎসবে মুখরিত, আন্দোলিত, জীবনের জয়গান ধ্বনিত।
কথন পর্বে চিত্রশিল্পী অধ্যাপক সুশান্ত অধিকারী বলেন, আমরা যারা গ্রামে বেড়ে উঠেছি, তারা শাপলার বিলে সাঁতার কেটেছি। কাশবনে ঘুরে বেড়িয়েছি। তাদের অনুভবে শরৎ ধরা দেয় অনন্যরূপে। শহরের শিশুদের কাছে হয়তো এই রূপ অচেনা। আমাদের অভিভাবকদের দায় রয়েছে, আমাদের সন্তানদের প্রকৃতির এই রূপবৈচিত্র্য সম্পর্কে জানানোর।
বাংলাদেশ গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের সভাপতি কাজী মিজানুর রহমান বলেন, গ্রামে এখনো কিছু কিছু প্রকৃতির বৈচিত্র্য দেখা যায়। এই রূপবৈচিত্র্যের সঙ্গে আমাদের সন্তানদের পরিচয় করিয়ে দিতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সহ-সভাপতি নিগার চৌধুরী বলেন, বাংলার ছয়টি ঋতুর আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে, আলাদা বার্তা আছে। শরৎ ঋতুকে বলা হয় শুভ্রতার প্রতীক। এই ঋতুতে আমাদের মাঠে নতুন ফসলের বার্তা আনে, যা ঘরে তুলে নবান্ন উৎসব করি। শুদ্ধ সুন্দর শুভ্রতায় এই শরৎ সবার জীবনে মঙ্গল বয়ে আনুক।
উৎসবে শিশু-কিশোরদের পরিবেশনায় অংশ নেয় সীমান্ত খেলাঘর আসর, গেণ্ডারিয়া কিশলয় কচি-কাঁচার মেলা, সুরবিহার শিল্পবৃত্ত। একক সংগীত পরিবেশনায় অংশ নেন প্রিয়াংকা গোপ, তানভীর আলম সজিব, অনিমা রায়, ফেরদৌসী কাকলিসহ আরও অনেকে। দলীয় সংগীত পরিবেশন করেছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী, নির্ঝরণী সংগীত একাডেমি ও সমস্বর। কথক নৃত্য সম্প্রদায়, বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টস, বেনুকা, ধৃতি নর্তানালয়, স্পন্দনের শিল্পীরা দলীয় নৃত্য পরিবেশন করেন।
মন্তব্য করুন