আনিসের অস্থিরতায় আমারও ঘুম ভেঙে গেল। ঘরে আলো নেই। গভীর রাত। কিন্তু সে ঘুমাচ্ছে না। বললাম, ‘কীরে সমস্যা কী’? আমার দরাজ আওয়াজে সে যেন আরও গুটিয়ে গেল। রাতে সময় মত খেতেও আসেনি। মেসের নিয়ম, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খেতে না আসলে শেষের জনকেই সব গোছাতে হয়। আনিস যেন তাতেও রাজি। সম্ভবত সে প্রেমে পড়েছে। নতুন দিওয়ানা। এ কারণেই কিছুক্ষণ পরপর ফোন আসে। আর রুমের বাইরে যায়।
এক ধরনের অস্থিরতা, চাঞ্চল্য কাজ করছে আনিসের মধ্যে। প্রেমে পড়লে সাধারণত এটিই হওয়ার কথা। একটু এগিয়ে অন্ধকারে ঢিল মেরে বললাম, ‘কীরে, কাল কী দেখা হবে?’ সাথে সাথেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘দোস্ত, আমি পাগল হয়ে যাব। ও তো রাজি। কালই প্রথম দেখা। কী করব, কী বলব, কিছুই বুঝতে পারছি না রে!’ বুঝলাম, ঢিলটা মিস হয়নি।
বন্ধু হলেও আনিস আমাকে গুরু বলে মানে। আমি নাকি সবকিছুই একটু আগেভাগে বুঝতে পারি। সেজন্য সব বিষয়ে আমার কাছে পরামর্শ চায় সে। আমিও চাওয়ামাত্র পরামর্শ দিই না। বলি, পরে বলব। এরপর কিছুটা ঘাটাঘাটি করে চিন্তা করে তারপর পরামর্শের ভান্ডো খুলি। তাতে আনিসের কাছ থেকে আদায় করা ট্রিট হালাল হয় বটে।
এই যেমন, আনিস বলল, সে যাকে পছন্দ করে, তার সাথে প্রথম দেখায় সে কী বলবে, কী পরবে বা কী আচরণ করবে, তা জানতে চায়। আমি বুঝতে পারলাম, দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে কিছুটা হলেও সমস্যা হচ্ছে আনিসের। এক ধরনের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা কাজ করছে তার। এ কারণে তার হার্টবিট এখন অনেক বেশি। যাকে বলে, হৃদস্পন্দন।
আনিস আমাকে বলল, ‘দোস্ত, আমার তো ঘুম আসছে না! কী করব, বল না। আমার মন তো উথাল-পাথাল করছে!’ ঠান্ডা মাথায় বললাম, ‘সমস্যাটা তোর মনে না নারে পাগল, সমস্যাটা তোর মগজে। সেখানেই আসলে ফুল ফোটে প্রেম-ভালোবাসার। এর ফলে ব্রেইনে যে জটিল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়, তাতে বোঝা যায়, এটা স্বাভাবিক এবং ব্যায়াম, পানি ও খাবারের মতোই প্রয়োজনীয়।’
আমি বললাম, ‘এই মুহূর্তে তোর ব্রেইনের এক ডজন অংশ সচল। সুখানুভূতির হরমোন ডোপামিন, আদর-সোহাগের হরমোন অক্সিটোসিন এবং অ্যাড্রেনালিনের মতো রাসায়নিক নির্গমণে একত্রে কাজ করছে তারা। যার তোর মধ্যে এক ধরনের উচ্ছ্বাসপূর্ণ আবেগ তৈরি হচ্ছে।’
আনিস বলল, ‘তাহলে প্রেম হৃদয়ে বাস করে, কবি, সাহিত্যিকদের এমন দাবি কি ভুল?’ আমি বললাম, ‘আমরা যখন কাউকে ভালোবাসি, তখন শারীরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বেশিরভাগই অথবা অন্তত শুরুটা ঘটে মস্তিষ্কে। প্রেম-ভালোবাসা আসলে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত ব্রেইনকে একত্রিত রাখতে সহায়তা করে। গবেষণায় এর বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে সিঙ্গেল অথবা প্রেমবিরহে থাকা ব্যক্তির মস্তিষ্কে।’
দোস্ত, ‘বিরহের ভয়ও তো আছে!’ বললাম, ‘খুব স্বাভাবিক’। আনিস বলল, ‘বিরহ হলে কী কী হতে পারে, বল তো?’ এককথায় বললাম, ‘বারবার স্মৃতি রোমন্থন হতে পারে, ভেরি সিম্পল’। ‘শুধু এটুকুই?’ আমি বললাম, ‘এটাই মূল। বারবার তোর মনে হবে সেই প্রেমিকার কথা। তার সাথে কাটানো আনন্দঘন মুহূর্ত, স্মৃতিপূর্ণ এলাকা, অবস্থান, সবই তোকে মনে করিয়ে দেবে বিরহ ব্যাথা। পুরোনো সুখস্মৃতি, সুখানুভূতিই তখন বিঁধবে কাঁটার মত। ফলে ব্রেকআপের বেদনায় ট্রমা তৈরির ঝুঁকি বেশি। ব্যক্তি তখন অতিরিক্ত চিন্তা ও দুঃখ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। জীবনের সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনাগুলোর একটি হতে পারে সম্পর্কের সমাপ্তি।’
‘আর না দোস্ত, প্লিজ। আমি কোনো ব্রেকআপ চাই না। বরং সম্পর্ককে সাদরে লালন করতে চাই। সেটা করতে কী করতে পারি বল। ‘আমি বললাম, ‘সম্পর্ককে গুরুত্ব দিতে হবে। তাকে পছন্দের কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে। আবেগ নিয়ন্ত্রণের স্কিল বাড়াতে হবে। প্রিয়জনের ইতিবাচক বিষয়গুলো খুঁজতে হবে। সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধা, মমত্ব রাখতে হবে। যেসব কারণে সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, তার সীমানা নির্দিষ্ট করতে হবে। এ নিয়ে কথা বলতে হবে খোলামেলা। একসাথে আনন্দে কাটাতে কিছুসময় বের করে নিতে হবে। তাহলেই সম্পর্ক টেকসই হবে।’
প্রেম ভালোবাসার পোস্টমর্টেম করতে করতে কখন যে ভোর হয়ে গেল, টের পাইনি। আনিস বলল, ‘দোস্ত, আজ ভালোবাসা দিবস। বন্ধু হিসেবে প্রথম ভালোবাসা তোর জন্য।’ বাইশ বছর পর সেই আনিসের সাথে দেখা। শাহবাগে ফুল কিনছে। মাঝ বয়স পার করছি দু’জনই। আনিস আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘দোস্ত, তোর জন্য আজও অটুট, যেন সদ্য ফোটা ফুল’।
মন্তব্য করুন