শ্রাবণ মাস। চারিদিকে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। মহেন্দ্রভবনে সকলের একসঙ্গে চিৎকার শোনা যাচ্ছে। কী হয়েছিল সেদিন মহেন্দ্রভবনে? যে ঘটনা কেউ কখনো ভাবতেই পারে না সেই দৃশ্য দেখেছিল মহেন্দ্রবাবু।
মহেন্দ্র বাবুর চার ছেলে ও একমেয়ে। চার ছেলের বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ এনেছে মহেন্দ্রবাবু। গিন্নি মার পছন্দে সব বউ ঘরে আসলেও ছোট ছেলে রতন নিজ পছন্দে বিয়ে করে কলেজপড়ুয়া পরমা সুন্দরী এক মেয়েকে। বড় বউ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সব কাজ করে। মেজ ও সেজ কাজে সহায়তা করে বড় বউকে।কিন্তু ছোট বউ ননীর পুতুল। কোন কাজে তার মন নেই। গান বাজনা নাটক আর স্বামীকে নিয়ে হৈচৈ করা তার নিত্য দিনের কাজ। বড় বউ নিসন্তান। মেজ সেজ আর ছোট ছেলের ঘরে একজন করে নাতি জন্ম নিয়েছে। সেই দিক থেকে মহেন্দ্র বাবু নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করে। মহেন্দ্রবাবু তার বড় ছেলের বউকে খুব মায়া করে। সন্তান নেই জন্য বড় বউকে কেউ যেন আঘাত করতে না পারে সেদিকে তাঁর দৃষ্টি থাকে সবার আগে।
আয়কর অফিসে চাকুরী করতেন মহেন্দ্রবাবু। সুন্দর একটা নিয়মের মধ্যে উনি সংসার পরিচালনা করতেন।কোন অভাব ছিলনা মহেন্দ্র পরিবারে।কিন্তু নাতি অভি, দ্বীপ,গোপাল, জন্মের পর থেকেই মহেন্দ্রপরিবারে খরচ বেড়ে যায়। মহেন্দ্র বাবু তিন ছেলেকে নিয়ে রাতে খাবার টেবিলে বললেন উনি তিন নাতির সকল খরচ বহন করবেন। কিন্তু ছোট ছেলের বউ কনার উপরে তাঁর অভিমান যেন কোন ভাবেই কমে না। সবাই চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই মহেন্দ্র বাবু কনাকে পছন্দ করে না।ছোট ছেলের ঘরে নাতি গোপাল ছিল তাঁর প্রানের চেয়েও প্রিয়। সবাই বলত কনাকে তোমাকে পছন্দ করে না তো কি হয়েছেকিন্তু তোমার ছেলে তো বড়বাবুর প্রানের চেয়েও প্রিয়। কনা সবার কথা মন খারাপ করে শুনত আর বলত একদিন বাবার ভুল ভাঙ্গবে আমার প্রতি। কনার চঞ্চলতা মহেন্দ্রবাবু একদম পছন্দ করত না।
মহেন্দ্রবাবু প্রতিমাসে একবার করে নিজ দেহের সব কিছু পরীক্ষা করতেন। স্ত্রীকে নিতেন সাথে। প্রতিবারের মতো এবারও তারা ডাক্তারের কাছে গেলে তাদের সিরিয়াল নম্বর পড়ে ৪১। বাসায় আসতে রাত হবে। গিন্নি মা মোবাইলে জানালেন বড় বউকে।ছোট ছেলে রতন বাসায় নেই। মহেন্দ্রবাবুর তিন নাতির বয়সের ব্যবধান একবছর।সবার ছোট গোপাল। বয়স সব মাত্র ৭ বছর। তার সকল আবদার দাদুর কাছে। গোপালের অনেকদিনের শখ একটি ক্রিকেট ব্যাটের। কেউ কিনে দেয় না তাদের তিন ভাইয়ের জন্য একটি করে ব্যাট। তাই আজ দাদুর কাছে গোপালের আবদার ছিল ও দাদু দাও না একটি করে ব্যাট কিনে বড়দা মেজদা ও আমাকে। পুজোতে কিছু নেব না তোমাদের কাছে থেকে। দাদু নাতির আবদার ফেলতে পারে না। রাতেই কিনে আনে তিন নাতির জন্য তিনটি ব্যাট।
রাতে বাসায় ফিরতে ফিরতে মহেন্দ্রবাবুর রাত ১২টা। গোপালের প্রথম কথা দাদু আমার ব্যাট কই? সাদা কালো মেশানো রঙের তিনটি ক্রিকেট ব্যাট দেখে গোপালের সে কি আনন্দ। দাদুকে জড়িয়ে ধরে সাত বছরের গোপাল বলে আমার দাদু পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দাদু। রাতে মহেন্দ্রবাবুর বিছানায় ঘুমায় গোপাল।
পাশের বাড়ির শেফালি মাসি প্রতিদিন একবার করে আসে মহেন্দ্র বাবুর বাসায়। অভিযোগ করে গোপালকে নিয়ে। কারন গোপালের দুষ্টুমি তে পাড়া প্রতিবেশীও বাড়ির মানুষ নাজেহাল।অপরাধ করেই একটা মিষ্টি হাসি দেয় গোপাল। গলা জড়িয়ে ধরে মিষ্টি করে বলে একটা চুমু দিব। রাগ করো না। ক্ষমা করো। আর করব না।
দুর্গাপূজার আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। প্রতিমা বানানোর কাজ প্রায় শেষের দিকে। মহেন্দ্রবাবু তিন নাতিকে নিয়ে সন্ধ্যায় যাবেন মাকে দেখতে। ঘর বাড়ি পরিস্কার করা হচ্ছে। গোপালের বায়না পাড়ায় একটা ক্রিকেট টুর্নামন্টে হতে হবে পূজা উপলক্ষে। গোপালের বাবা ও জেঠুরা সন্মতি দেয় গোপালের ইচ্ছে বাস্তবায়নের জন্য। শুরু হয় গোপালের অনুশীলন। সকালে ঘুম থেকে উঠে বড় দুই দাদাকে নিয়ে চলে যায় মাঠে। কিন্তু মহেন্দ্রবাবুর ছোট ছেলের বউ কনা কিছু তেই খুশি না গোপালের এই ধরনের আচরণে। আর মাত্র কটা দিন বাকী পরীক্ষার।
গোপালের আচরণে মনে হয় গোপাল অনেক বড় হয়ে গেছে। পাড়ার ছোট ছোট ছেলেদের সে শাসন করে। বড়দের মতো করে কথা বলে। উপদেশ দেয় নিয়মিত পড়াশোনা করার জন্য। কিন্তু নিজের বেলায় নিয়মের ব্যতিক্রম করে। কিন্তু তার মা কনা ছেলে গোপালের প্রতি অনেক যত্নশীল। গোপালকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে আদর করে বলে পরীক্ষার আর মাত্র কটা দিন বাকী ভালো করে পড়াশোনা করার জন্য। কিন্তু গোপাল তার মায়ের কথা শোনে না। সকাল ঘুম থেকে উঠেই ব্যাট নিয়ে চলে যায় মাঠে। প্রতিদিন গোপালকে জোড় করে মাঠ থেকে আনতে হয় তার মা কনাকে। এটাতে কনা প্রচণ্ড রকমের বিরক্ত হয়।
সকাল থেকেই আকাশ মেঘে ঢাকা। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। মহেন্দ্র বাবুর পাশের বাড়ি ছিল ঘোষ বাড়ি। ঘোষ বাড়িতে ছিল মস্ত বড় একটা উঠান।সেই দিন গোপাল বৃষ্টির কারনে মাঠে না গিয়ে ঘোষ বাবুর উঠানে তিন ভাই ও ঘোষ বাড়ির ছেলে দেবু কে নিয়ে খেলা শুরু করে সকাল থেকেই। কনা গোপালকে বাড়িতে না দেখে বৃষ্টির মধ্যে যায় মাঠে। কিন্তু সেখানে কেউ নেই। মাঠ ফাঁকা। একদিকে দুঃচিন্তা অন্য দিকে রাগ। নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা কনা। কনা শেফালী মাসির কাছে থেকে জানতে পারে গোপাল ঘোষ বাবুর উঠানে খেলছে। কনা প্রচণ্ড রাগ ও অভিমান নিয়ে গোপালের কাছে যায় আর গোপালের ব্যাট টি ফেলে দেয় ঘোষ বাবুদের পুকুরে। পরদিন ছিল গোপালের গৃহ শিক্ষকের কাছে শারিরীক শিক্ষা পরীক্ষা। জোড় করে কনা নিয়ে আসে ঘরে গোপালকে। পড়তে বলে শারিরীক শিক্ষা। কিন্তু সাত বছরের গোপালের মন পড়ে থাকে ব্যাটের দিকে। অবিরত কাঁদতে থাকে গোপাল।
সন্ধ্যা নামবে ঠিক এরকম সময়ে সবার অগোচরে গোপাল যায় পুকুর ঘাটে। বাঁশের মাচাং এর উপর থেকে লাঠি দিয়ে খুঁজতে থাকে তাঁর ব্যাট টি। কিন্তু বাঁশ গুলি পিচ্ছিল হবার কারনে গোপাল পড়ে যায় পুকুরে।সাঁতার জানত না সে।মহেন্দ্র বাবু গোপাল কে আঁদর করতে গেলে গোপাল কে পায় না ঘরের কোথাও। সারাবাড়ি তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয় গোপালকে। গোপাল নেই। কনার চিৎকার। আশে পাশে চারিদিকে খোঁজ চলে। থানায় জানানো হয়।কিন্তু কনা বার বার শুধু পুকুরের দিকে যায়, আর বলে এখানেই খোঁজ গোপাল সোনা এখানেই থাকবে।ডুবুরি নামে রাত ১০ টায়।কিন্তু না। একটাই উত্তর নেই গোপাল। কনার কান্নার শব্দে রতন নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। সে তো বাবা। পুকুরে নেমে খুঁজতে থাকে রতন তার বুকের মানিককে। রতনের পায়ে লাগে একটি ছোট্ট শিশুর হাত। ডুব দেয় । তুলে নেয় তাঁর বুকের মানিককে। গোপাল নেই। অনেক আগেই সে মারা গেছে। ঘোষ বাবুর বউ বলে আমি শব্দ শুনেছিলাম। কিন্তু আসা হলো না। কাজ আর কাজ। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকে ঘোষ বাবুর বউ।
মহেন্দ্র পরিবারে সেদিন আলো জ্বলে নাই। মহেন্দ্র বাবুর বাড়িতে পূজোতে আর ঢাক বাজবে না। আকাশের দিকে চেয়ে কাঁদতে কাঁদতে জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী মহেন্দ্রবাবু বলে দুর্গা মা আসবে না কোনদিন যতদিন গোপাল না ফিরবে আমার বাড়িতে।সব কিছুর পরেও মানুষ স্বাভাবিক হতে হয় প্রকৃতির নিয়মে কিন্তু গোপালকে কি কনা ভুলতে পারবে? গোপাল কি ফিরবে কনার কোলে। জামাল গঞ্জের বোসপাাড়ায় মহেন্দ্র পরিবারের জন্য সবাই প্রার্থনা জানায় ঈশ্বরের কাছে গোপালকে ফিরিয়ে দাও। কনাকে দুঃখ সইবার শক্তি দাও।
মন্তব্য করুন