পার্বত্য জেলা বান্দরবান। ভ্রমণপিপাসুদের মনের সব খোরাক যেন এই জেলাতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ঘন সবুজে ঢাকা পাহাড়, উন্মত্ত জলপ্রপাত এবং ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠীর মানুষগুলো পরম মমতায় ডেকে নেয় পর্যটকদের। প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যকে আলিঙ্গন করা যায় এই জেলায়।
অবশ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভালো নেই এই জেলায় পর্যটন ব্যবসায় বিনিয়োগকারীরা। এক সময়ে হোটেল-মোটেল আর কটেজগুলোতে জায়গা পাওয়া কষ্টকর ছিল পর্যটকদের ভিড়ে। নানা কারণে সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশে। এই পর্যটক খরার প্রভাব পড়েছে জেলার পরিবহন থেকে শুরু করে ছোট ছোট কটেজ, খাবার হোটেলসহ সব ছোট-বড় ব্যবসাতেও।
পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বান্দরবানের লোকজন বলছেন, ২০২০ সালে মহামারি করোনায় তাদের ব্যবসায় ধস নামে। ওই সময় বন্ধ হয়ে যায় সব পর্যটন স্পট। তবে ২০২২ সালে তারা ঘুরে দাঁড়ান। এর মাঝে পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গ্রুপের আনাগোনায় ফের মুখ থুবড়ে পড়েছে বান্দরবানের পর্যটন ব্যবসা।
অবশ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় আশাবাদী স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে পর্যটন ব্যবসায় যুক্ত ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, দিনে-দুপুরে সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফের সদস্যের ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় তারা আঁতকে উঠছিলেন। এই সংগঠনটির আনাগোনায় নিরাপত্তার কারণে পর্যটন স্পটগুলোও বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তবে যৌথ বাহিনীর চলমান অভিযানে তারা আশায় বুক বাঁধছেন।
বান্দরবান শহরের অবস্থিত হোটেল হিল ভিউ আবাসিকের ব্যবস্থাপক আবদুর রহিম কালবেলাকে বলেন, আগে তো পর্যটকদের তারা জায়গা দিতে পারতেন না। এখন সেই পর্যটকদের ভিড় নেমে এসেছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশে।
তিনি জানান, নানা কারণে দুর্গম পর্যটন স্পটগুলোতে পর্যটকরা যেতে পারছেন না। এজন্য দূর থেকে পর্যটক আসছেন না। যারা আসছেন, আশপাশের জেলার বাসিন্দা তারা। এজন্য আবাসিক হোটেলগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ অভিযানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা করছেন তারা।
বান্দরবান জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, জেলা প্রশাসনের তালিকায় এখানে ৭৪টি পর্যটন স্পট রয়েছে। এর সবগুলোই চালু রয়েছে। তবে অন্তত ১০টি স্পট এলাকায় নানা কারণে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় পর্যটকদের নিরাপত্তার স্বার্থেই সেখানে যেতে নিরুৎসাহীত করা হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, তা ছাড়া এখন বর্ষার মৌসুম হওয়াতেও এই জেলায় পর্যটক কম আসছে- এটা স্বাভাবিক। জেলা প্রশাসনসহ অন্যান্য সরকারি সংস্থাগুলো সব সময়েই পর্যটকদের নিরাপত্তায় তৎপর রয়েছে।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, বান্দরবান সদর ছাড়াও রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় পর্যটন স্পট বেশি। এসব এলাকাতে পর্যটকদের আকর্ষণও বেশি। কিন্তু এই তিন উপজেলার বেশির ভাগ পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পর্যটকরা ঝুঁকি বিবেচনায় যাচ্ছেন না। যার কারণে বড় প্রভাব পড়ছে এই খাতে।
বান্দরবানের স্থানীয় সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, রুমা ও থানচি ও রোয়াংছড়ি উপজেলার পর্যটন স্পটগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ নেই। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে সেখানে পর্যটকরা যেতেও পারছেন না। অবশ্য কেউ কেউ স্থানীয়দের সহায়তায় যাচ্ছেন। অবশ্য সদর উপজেলার নীলগিরি, নীল আঁচলসহ প্রসিদ্ধ পর্যটন স্পটগুলো চালু রয়েছে। সেখানে পর্যটকরা আসলেও কম।
এই গণমাধ্যমকর্মী আরও বলেন, বান্দরবানে পর্যটক কম আসার প্রভাবটা শুধু এই খাতের ব্যবসায়ীদের ওপরই পড়ছে না, এটা জেলার সব পেশার মানুষের ওপরই পড়ছে। কারণ এই পর্যটকদের ওপর নির্ভর করে নানা ব্যবসা রয়েছে।
প্রায় ১০ বছর ধরে পাহাড়ে পর্যটকদের বহনকারী জিপ গাড়ি (চান্দের গাড়ি) চালান ইকবাল হোসেন। বান্দরবান জেলা বাস টার্মিনালের সামনে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, পর্যটক না থাকায় তারা দিনের বেশির ভাগ সময়ে বসেই থাকছেন। এতে সংসার চালানো কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। করোনার সময় থেকে মাঝে বছর খানেক ভালো গেলেও এখন আবার সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
ইকবাল অবশ্য বলেন, কুকি-চিনের লোকজনের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে। এখন হয়তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। তবে বর্ষা মৌসুম বাদ দিয়ে তারা সামনের শীতের মৌসুমের অপেক্ষা করছেন।
ট্যুরিস্ট পুলিশের বান্দরবান জোনের ইনচার্জ পরিদর্শক স্বপন কুমার আইচ কালবেলাকে বলেন, এখন পর্যটকদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। তবে দুই ঈদে তা বেড়েছিল।
তিনি বলেন, এই সময়টাতে বান্দরবানের আশপাশের জেলা থেকে মূলত পর্যটকরা আসছেন। তারা আবার দিনেই চলে যাচ্ছেন। তা ছাড়া বর্ষা মৌসুমে এমনিতেই পর্যটকে ভাটা থাকে।
মন্তব্য করুন