বাংলাদেশের আইনে উদাহরণ হয়ে রইলেন অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন। নারী অধিকার আদায়ে হলেন ইতিহাসের অংশ। বাংলাদেশে এ অভিনেত্রীই একমাত্র নারী, যিনি নিজ সন্তানের পূর্ণ অভিভাবকত্ব পেয়েছেন।
২০১০ সালে মাশরুর সিদ্দিকীর সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন অভিনেত্রী বাঁধন। কিন্তু চার বছর পর সংসার ভাঙে তাদের। এরপর প্রশ্ন ওঠে কে পাবেন তাদের একমাত্র কন্যাসন্তান মিশেল আমানি সায়রার অভিভাবকত্ব।
মা হিসেবে সন্তানের অধিকার পাওয়ার জন্য মেয়ের কাস্টডি চেয়ে ২০১৭ সালে মামলা করেন অভিনেত্রী। দীর্ঘ নয় মাস আইনি লড়াইয়ের পর ২০১৮ সালের ৩০ এপ্রিল আদালত বাঁধনকে তার মেয়ের একক অভিভাবকত্ব দেন।
সে সময় আদালতের দেওয়া রায়টি ছিল ব্যতিক্রম। কেননা বাংলাদেশে নাবালক সন্তানের বাবা জীবিত থাকলে মাকে অভিভাবকত্ব দেওয়া হতো না।
সম্প্রতি দেশের অভিভাবকত্ব আইন পরিবর্তনের জন্য হাইকোর্টে পাঁচটি সংগঠনের করা একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে রুল জারির পর আবারও আলোচনায় আসেন বাঁধন। এর আগে সন্তানের অভিভাবকত্ব চেয়ে এই অভিনেত্রীর করা সংগ্রামের বিষয়টি উঠে আসে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদে।
পুরো বিষয়টি নিয়ে কালবেলার সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছেন আজমেরী হক বাঁধন। তিনি জানান, বিষয়টি এমন নয় যে, তার করা মামলার কারণেই আদালত রুল জারি করেছেন। তার মামলাটি রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে রিট দায়ের করার পর আদালত রুল জারি করেছেন। এই আইন পরিবর্তনের জন্য যে পাঁচটি সংগঠন উদ্যোগ নিয়েছেন, তাদের সাধুবাদ জানিয়েছেন অভিনেত্রী।
উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বাঁধন বলেন, এই রুল জারি হওয়ায় আমি ভীষণ আনন্দিত। ধর্মীয় ও আইনগতভাবে কিছু জায়গায় মেয়েদের বৈষ্যমের শিকার হতে হয়। উত্তরাধিকার আইনে বা সন্তানের অভিভাবকত্ব আইনেও রয়েছে এই বৈষম্য। এগুলোর পরিবর্তন দরকার।
সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছেন বাঁধন। যখন মামলা করেছিলেন, তখন এসব বিষয়ে বেশ আনাড়ি ছিলেন এই অভিনেত্রী। নিজের অধিকার আদায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে লজ্জা পেতেন তিনি। ভয়ও কাজ করত মনে। সেসব দিনের স্মৃতি টেনে বাঁধন আরও বলেন, যখন আমি প্রসেসটার মধ্যে ঢুকি, তখন এত সচেতনভাবে ঢুকিনি। আমি জাস্ট আমার সন্তানকে আমার সঙ্গে রাখতে চেয়েছি। মা হিসেবে শুধু এটুকু চেয়েছি—সন্তান আমার কাছে থাকবে।
তিনি আরও বলেন, সন্তানকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার একটি প্রসেস শুরু হয়েছিল তখন। আমার সন্তানকে দেশের বাইরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তার বাবা। ওই জায়গা থেকেই শুরু। আমি যখন এই অভিভাবকত্ব পাওয়ার আইনি জার্নিটা শুরু করি, তখন জানতান মা যে মাকে গারডিয়ানশিপ দেওয়া হয় না। কিন্তু আমি গার্ডিয়ানশিপ চেয়েছিলাম। পরে জানতে পারলাম যে, মাকে আসলে কাস্টডি দেওয়া হয়; কিন্তু গার্ডিয়ানশিপ বাবারই থাকে; ন্যাচারাল গার্ডিয়ান বাবাই হন।
অভিনেত্রী বলেন, আমার সন্তানের ভরণপোষণ কিন্তু তার বাবার থেকে নিই না। আগেও নিইনি। আমি যখন গার্ডিয়ানশিপ চাই, তখন আমি বলে দিয়েছিলাম যে, আমি আমার সন্তানের ভরণপোষণ করেছি এবং আমিই করব যতদিন পর্যন্ত ও অ্যাডাল্ট হবে।
বাঁধন আরও বলেন, এই জার্নিটা খুবই কঠিন ছিল। কারণ তখন তো আমি আর আজকের বাঁধন ছিলাম না। আমি তখন খুব লজ্জা পেতাম। কিন্তু এখন আর আমি আমার অধিকার আদায়ে লজ্জা পাই না। সমাজে গলা উঁচু করে আমার পাওনা চাওয়ার সাহস ছিল না তখন। কিন্তু মা হিসেবে আমি পণ করেছিলাম যে, আমার সন্তানকে আমি নিয়ে যেতে দেব না। তখন আমার ভীষণ কঠিন একটা সময় গিয়েছে। কারণ আমার নিজের আইনজীবীও আমার সঙ্গে অনেক ঝামেলা করেছেন। আশপাশের মানুষ তো ঝামেলা করেছেই। এরপর যখন আমি রায়টা পাই, ভীষণ ভালো লেগছে। কারণ আমি সন্তানকে আমার কাছে রাখতে চেয়েছি। সেটা করতে পেরেছি।
অভিনেত্রী বলেন, যখন আমি রায়টা পাই তখন আমি জানতাম না যে এটা কত বড় একটি ঘটনা। কারণ আমি এত সচেতন ছিলাম না। সময়ের সঙ্গে আমি এই রায়ের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছি। কিন্তু শুরুতে আমি ছিলাম শুধুই এমন একজন মা, যিনি তার সন্তানকে কাছে রাখতে চায়।
সন্তানের ক্যারিয়ার কী হবে, এমন প্রশ্নের উত্তরে বাঁধন বলেন, আমার সন্তান যেটা হতে চায় হবে। কিন্তু আমি চাই তাকে একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। চেষ্টা করব ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার। বাকিটা ওর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে যে ও কী করবে। এটা আমি ওর ওপরেই ছেড়ে দিতে চাই।
বাঁধনের বিষয়ে রিটের পক্ষের সংগঠনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাঁধন তার মেয়ের একক অভিভাবকত্ব পেয়েছেন, সেটি রিটে উদাহরণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। কারণ বাংলাদেশে এ অভিনেত্রীই একমাত্র নারী, যিনি সন্তানের পূর্ণ অভিভাবকত্ব পেয়েছেন।