এ বছর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৭৫ বছর পূর্ণ করল এবং বলা যায়, সেরা সময় পার করছে উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটি। টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় এবং সেই ক্ষমতা ভোগ করছে অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে। পরিষ্কার করেই বলা চলে, আওয়ামী লীগে রাজনৈতিক চর্চা কমেছে, ক্ষমতা ও আধিপত্য চর্চা বেড়েছে।
অসংখ্য নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মী তৃণমূলে আওয়ামী লীগের জনভিত্তি। কিন্তু সে তৃণমূলেই আওয়ামী লীগ আজ নিজের প্রতিপক্ষ। বিএনপি ছাড়া গত ৭ জানুয়ারি যে দ্বাদশ নির্বাচন হলো, তার মাধ্যমে আবারও সংসদে নিরঙ্কুশ আধিপত্য নিয়ে দল ক্ষমতায় এসেছে। এটি যতটা না ছিল নির্বাচন, তার চেয়েও বেশি ছিল দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার কৌশল।
নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলেরই অন্য প্রার্থীদের নির্বাচন করার অনুমোদন দিয়ে দল একটি ভোটের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। তবু ভোটার উপস্থিতি ৪২ শতাংশের বেশি হলো না। তবে এতে করে বিবাদ, বিদ্বেষ আর শত্রুতা চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। সংসদ নির্বাচন চলে গেছে, স্থানীয় নির্বাচনও। সংসদ নির্বাচনের সময় প্রতিটি জনপদে চিত্র ছিল এমন—নৌকার প্রার্থী তার দলেরই স্বতন্ত্র প্রার্থীকে অশ্রাব্য সব গালি দিচ্ছেন, তার লোকেরা স্বতন্ত্র প্রার্থীর সদস্যদের ওপর হামলে পড়ছেন। উল্টোটাও ঘটছে অনেক জায়গায়। স্বতন্ত্র প্রার্থী তার পেশিশক্তি প্রদর্শন করছেন দলীয় নৌকার প্রার্থীকে।
এ অবস্থা এখনো চলছে। কেউ বিশ্বাস করবে না যে, তারা একই আদর্শের অনুসারী, একই দল করে, জেলা এবং উপজেলা বা পৌর বা ইউনিয়ন পর্যায়ে একই দলীয় অফিসে বসে। তারা সবাই জয় বাংলা স্লোগান দেয়। খোদ প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা একাধিকবার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। সাধারণ সম্পাদকও বলেছেন সংযত আচরণ করতে। কিন্তু তারা থামছে না।
থামার কথাও নয়। চার মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা এক আওয়ামী লীগের ভেতরে এখন অনেক অনেক লীগ। সবাই ক্ষমতা চায় এবং যার যার জায়গায় ক্ষমতা চর্চা করেছে এ সময়টায়। আধিপত্য আর অর্থবিত্তের সবচেয়ে সহজ উপায় এমপি হতে পারা, উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়া, পৌর সংস্থার মেয়র হওয়া এবং এমন এক নির্বাচনে যেখানে বিরোধী দল বলে কিছু নেই। সব নিজেদের মধ্যে। তাই মরিয়া হয়ে মাঠ দখলের প্রতিযোগিতা।
আওয়ামী লীগ নেতাদের এই সংঘাত, সহিংসতা এবং একে অন্যের বিরুদ্ধে যে খুন-খারাবির হুমকি চলছে, সেটা কি তবে দলের ভিতের স্থায়ী বিরোধের সৃষ্টি করছে? এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে গৃহবিবাদ কোনো কোনো স্থানে এমন পর্যায়ে গেছে যে, একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অবশ্যই থাকবে এ বিদ্বেষ চর্চার।
আমাদের দলীয় রাজনীতি যেহেতু সন্ত্রাসের শিক্ষাকেই অস্ত্র বানিয়েছে, তাই এর ফল ভোগ করতে হবে দলকেই। কিন্তু কেন এত সহিংসতা? তাও নিজেদের মধ্যেই? কারণ হলো, পাওয়া না পাওয়ার বিরোধ, বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভ। সরকারি দল করা মানেই মুফতে অর্থবিত্ত আর আধিপত্যের মালিক হওয়া। এই ১৬ বছরে শাসক দলের সবাই পেয়েছে। কিন্তু কে কতটা পেয়েছে, কে বেশি পেয়েছে, কে কম পেয়েছে, কে কত বেশি পেয়েছে—সে দ্বন্দ্বটাই এখন মাঠে এসে প্রকাশিত হচ্ছে।
২০১৪ ও ২০১৮-তে মানুষের ভোটেরও প্রয়োজন হয়নি অনেক এমপির। তাই উন্নত সমাজ, নীতি, আদর্শের কথা এসব প্রার্থীর কাছে কোনো বিষয় নয়। বহুদিনের বিরোধ যেটা শত্রুতায় পরিণত হয়েছে। দল যখন দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতার অনুমোদন দিয়েছে, তখন আর কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছে না কেউ। সর্বশক্তি নিয়ে একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
শুধু গণতন্ত্র নয়, এ বোমা-বন্দুকের শক্তির সামনে আওয়ামী লীগের নিজস্ব অস্তিত্বের প্রশ্নটিও সরিয়ে রাখা যাচ্ছে না। এই যে উপজেলা নির্বাচন, সেখানেও একই চিত্র। প্রার্থীরা নির্বাচনের মাঠে নেমে মানুষের উদ্দেশে কিছু বলেননি। মানুষকে কোনো নতুন কথা, নতুন স্বপ্ন তারা জানাতে পারেননি। শুধুই একে অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার ছড়িয়েছেন। তীব্র বিরোধ আর কদর্য ভাষার প্রয়োগে নিজেদের রাজনীতির কথা তো ভুলেছেনই, হারিয়ে গিয়েছে উন্নয়নের গল্পও।
আওয়ামী লীগের মূল কথা উন্নয়ন। শেখ হাসিনার সরকার অবকাঠামো খাতে এত উন্নয়ন করেছে যে, তার এক লম্বা ফিরিস্তি মানুষকে মনে করিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু মাঠে নিজেদের সংঘাতে আড়ালেই থাকছে উন্নয়নের কথা।
বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ, সমালোচকরা এতদিন দুর্নীতি, অনিয়ম আর সন্ত্রাসের অভিযোগ করেছে। এখন নিজেরাই নিজেদের দুর্নীতিবাজ বলছেন, দখলবাজ বলছেন, সন্ত্রাসী বলছেন এবং বিএনপি-জামায়াত বলে তো গালি দিচ্ছেনই। অসাধারণ এক রাজনীতি। এ এক নতুন প্রকার দলীয় গণতন্ত্র।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু মানুষকে উন্নয়ন বোঝাতে যে শান্তি এবং পরিবেশ লাগে, সেটা দলের লোকেরাই নষ্ট করছেন। যদি এই ভোট-রাজনীতি আওয়ামী লীগ মডেলের রাজনীতি হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে জনপদে জনপদে অশান্তির মডেলটাও দাঁড়িয়ে যাবে। গত ১৬ বছরের স্থানীয় সরকারের যত নির্বাচন হয়েছে, সবটিতে আওয়ামী লীগের কোন্দল আর সহিংসতায় দলীয় কর্মীদের রক্ত ঝরেছে।
সাড়ে সাত দশক পার হওয়া দল আওয়ামী লীগ। অনেক বিপদ, অনেক আঘাতের পরও এই দলের সার্থকতা এখানে যে, তার দেশজুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নিঃস্বার্থ কর্মী। নীতি, নেতা, কর্মী ও প্রতিষ্ঠান যদি একটি রাজনৈতিক দলের পুঁজি হয়, তবে বলতেই হবে এই দলের প্রধান পুঁজি শেখ হাসিনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একবার বলেছিলেন, ‘শখের রাজনীতি আওয়ামী লীগ করে না। আওয়ামী লীগ নীতির রাজনীতি করে। তাই কোন সময় পুলিশের গাড়ি এসে তুলে নেবে, তার জন্য আমরা প্রস্তুত হয়েই থাকি।’ কালের পরিক্রমায় অনেক কিছু বদলেছে, বদলেছে আওয়ামী লীগ। অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো মনে হবে দল সেই অবস্থানে আর নেই। কিন্তু এ কথাও বুঝতে হবে যে, নানা বাধা-বিপত্তি, ঝড়-ঝাপ্টা, তুফান বয়ে গেছে দলটির ওপর দিয়ে। নিপীড়ন, শোষণ, নির্যাতন, জেল-জুলুম, হুলিয়া, হামলা-মামলার শিকার হয়েছে দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। সবই এখন ইতিহাসের অংশ। দলটির রয়েছে তিনটি পর্ব। পাকিস্তান পর্ব, ১৯৭৫-এর আগের পর্ব এবং জাতির পিতার শাহাদাতবরণের মাধ্যমে ১৯৭৫-এর পরবর্তী পর্ব। প্রতিটি পর্বেই দেখা গেছে, প্রেক্ষাপট বদলালেও আওয়ামী লীগ গণমুখী নীতি থেকে সরে আসেনি। বরং দৃঢ়তার সঙ্গে দেশ, জাতি ও জনগণের পাশে সবসময় রয়েছে এবং সেই দৃঢ়তার অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা নেতা, চিন্তাবিদ, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সফলতার সিঁড়ি পেরিয়ে উচ্চাসনে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। প্রশ্ন হলো, ঠিক বিপরীত অবস্থানে দল কতটা এগিয়েছে তার সঙ্গে? দলে স্বাধীনতাবিরোধী বা হাইব্রিড নামের অনুপ্রবেশকারী নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য নেতারা একটু অন্যমনস্ক। একটু শ্রান্ত হওয়ার এ সুযোগ গ্রহণ করলেন কিছু কিছু নবীন, ভূতপূর্ব ছাত্রনেতা কিংবা যুবনেতা; যারা এই প্রবীণ নেতাদের উপদেষ্টা ও সহায়ক হয়ে তাদের যারা সমর্থক ও পেটোয়া মানুষ, তারা কাতারে কাতারে দলে ঢুকিয়ে দিলেন। তারা আওয়ামী লীগে ঢুকেছে ঠিকই, তবে দল আর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ করেনি কখনো। এখন দেখার বিষয় কচুরিপানা পরিষ্কারের কাজটা কতটা শৃঙ্খলার সঙ্গে এগোতে পারে। তবেই দল তার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারকে আরও বেশি সুশাসনমুখী করে তুলবে।
রাজনীতিকে অর্থনীতির কথাও ভাবতে হয়। রোজগারহীন বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির জন্য, যার কথা সরকার নিজেও অস্বীকার করছে না। অস্বীকার করছে না ব্যাংক খাতে চলা অনিয়ম আর দুরবস্থার কথা, টাকা পাচারের কথা, দুর্নীতির কথা। তবে এসবের সমাধানে দাওয়াইটা কী, সেটা পরিষ্কার করছে না সরকার। শেয়ারবাজার নিয়ে তো আলোচনাই হয় না, কারণ ২০১০ সালে এটি ধ্বংসের পর আর উঠে দাঁড়ায়নি।
উন্নয়নের বিশাল সব যজ্ঞের মধ্যে মানুষের চিন্তা বেশি খাদ্য নিয়েই। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, দেশের ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় থাকেন। তার অর্থ হলো ১৭ কোটি জনসংখ্যার এ দেশে প্রায় পৌনে চার কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় ভোগেন। একই বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্যের বাড়তে থাকা দাম বাংলাদেশের ৭১ শতাংশ পরিবারের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা শুরু হয়েছিল করোনাকালের শুরুতে এবং সেটা এখনো চলছে। অথচ এর মধ্যে সাধারণ মানুষের আয় সেভাবে বাড়েনি।
অর্থাৎ, সব মিলিয়ে অর্থনীতির ছবিটা মোটেই ভালো নয়। বেহাল অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পথ হলো সুশাসন, যা এক বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনীতিবিদরা কথার পাহাড় গড়ে কত কিছু চাপা দিয়ে রাখেন। তাতে কিঞ্চিৎ শ্রুতিসুখ মিললেও কোনো সমাধানসূত্র মেলে না। কিন্তু অনেক কিছু চেপে রাখা যায় না যেমন যায়নি অর্থনীতির অবস্থা। জোর করে বিরোধী কণ্ঠ চেপে রাখা যায়, কিন্তু জোর করে ডলার বাড়ানো যায় না। মন্দাক্রান্ত অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটাবে কী করে, সেটাই দেখার অপেক্ষায় জাতি। শাসক দল তখনই বড় গলায় উন্নয়নের কথাটা বলতে পারে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, ঢাকা জার্নাল