পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এবং নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নামক সংগঠন দুটির সম্পর্ক ছিল কখনো পৃথক, কখনো এক। কৌশলগত কারণে গঠিত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ আলাদা সত্তা নিয়ে যাত্রা করে। ১৯৭১ সালে তা বিলুপ্ত হয়ে যায় ঐতিহাসিক কারণেই। ঢাকায় আওয়ামী লীগ গঠনের আগেই করাচিতে জিন্নাহর নামে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। পরে সোহরাওয়ার্দী হাল ধরেছিলেন। নাম হয়েছিল নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ।
ইতিহাসের নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে উপমহাদেশের প্রাচীনতম দলে পরিণত হয়েছে আওয়ামী লীগ। সবচেয়ে পুরোনো দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অর্ধেক বয়স যার। পাকিস্তান নামক বিসদৃশ দেশে আওয়ামী লীগ কঠিন, কঠোর সংগ্রাম-আন্দোলন, জেল-জুলুম, অত্যাচার-নিপীড়ন সহ্য করে ইতিহাসের শিখরে ঠাঁই নিয়েছে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গড়েছে অনেক রক্ত, জীবনদান ও যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে। কিন্তু পাকিস্তানের ২৪টি বছরে তাকে নানা ফ্রন্টে নানাভাবে লড়াই করতে হয়েছে। অবলম্বন করতে হয়েছে নানা কৌশল। জনগণের স্বার্থ রক্ষা হতে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার পথে ক্রমশ যেতে হয়েছে এগিয়ে। বিশাল ইতিহাস বহন করে চলেছে আওয়ামী লীগ নামক সংগঠনটি। কিন্তু দলের ইতিহাস মেলে না। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়ার আগে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে গঠিত হয়েছিল মানকি শরীফের পীর সাহেবের জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ নামের সংগঠন। এ ধরনের নামকরণের ক্ষেত্রে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুপ্রেরণাই ছিল মুখ্য। তার প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে পীর সাহেব এই দল গঠন করেন। ঢাকা হাইকোর্টে এক মামলা পরিচালনার জন্য সোহরাওয়ার্দী যখন ঢাকায় আসেন, তখন পীর সাহেবের অনুকরণে সংগঠনের নাম আওয়ামী মুসলিম লীগ রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার আগে ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে সোহরাওয়ার্দী পশ্চিমবঙ্গে বাস্তুহারা হয়ে পাকিস্তান আসেন। কিন্তু পূর্ববঙ্গে শাসকগোষ্ঠীতে ঠাঁই না হওয়ায় লাহোরে যান এবং পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। সোহরাওয়ার্দী লাহোরে নবাব ইফতিখার হোসেনের সহায়তায় গঠন করেন ‘জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ’। সিন্ধু প্রদেশেও গঠিত হয় জিন্নাহ আওয়ামী লীগ। এর কদিন পর ২৩ জুন ভাসানীকে সামনে রেখে ঢাকায় গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। অবশ্য ততদিনে সোহরাওয়ার্দী হয়ে উঠেছেন পাকিস্তানের উভয় অংশের প্রধান সংযোগ সেতু। জিন্নাহর মৃত্যুর পর মুসলিম লীগের নেতৃত্বের কোন্দল তীব্র হতে থাকলে দল ত্যাগ শুরু করে নেতাকর্মীদের একটা অংশ আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৪৯ সালের নভেম্বরে পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি চৌধুরী খালেকুজ্জামানকে লেখা এক পত্রে সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগকে একটি ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে পুনর্গঠিত করার আশা প্রকাশ করেছিলেন। অন্যথায় তারা তাদের নিজস্ব দল গড়ে তুলবেন বলে জানান। মুসলিম লীগের সংস্কার সাধনে ব্যর্থ হওয়ায় সোহরাওয়ার্দী একটি জাতীয় বিরোধী দল গঠনের দিকে মনোনিবেশ করেন। তার উৎসাহ ও নেপথ্য সহযোগিতায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলেও, গোড়ার দিকে তিনি দলটির সদস্য ছিলেন না। তিনি ছিলেন তখনো পাকিস্তান গণপরিষদে মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য। বিরোধিতার কারণেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান স্বয়ং উদ্যোগী হয়ে ১৯৪৮ সালের শেষদিকে সোহরাওয়ার্দীর গণপরিষদের সদস্য পদ বাতিল করেন। তিনি যখন জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন তখন জিন্নাহর বোন ফাতিমা জিন্নাহ তাকে সমর্থন করেন। এ সংগঠনটি পৃথকভাবে কাজ চালায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্য না গড়েই। একপর্যায়ে সোহরাওয়ার্দী জিন্নাহ লীগ বিলুপ্ত করেন।
১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক কর্মীদের এক সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দীকে সভাপতি ও একমাত্র সংগঠক করে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কোনো অংশ হিসেবে গঠিত হয়নি। কিংবা ১৯৫১ সালের জানুয়ারি মাসে বিলুপ্ত নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী লীগেরও অংশে পরিণত হয়নি। তবে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তানের করাচির অফিসকে গণ্য করা হতো কেন্দ্রীয় অফিস। অন্যদিকে প্রাদেশিক শাখা হিসেবে গণ্য করা হতো পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগকে। আওয়ামী লীগ পূর্ববঙ্গে দুই বছর ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল। কৌশলগতভাবে ১৯৫১ পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় দল পরিচিতির জন্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের ভিন্নমতাবলম্বী মুসলিম লীগারদের দ্বারা গঠিত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক শাখার পরিচয় বহন শুরু করে। পূর্ব বাংলার রাজনীতি থেকে সোহরাওয়ার্দীকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও যখন পূর্ব বাংলায় অসন্তোষ ঘনীভূত হচ্ছিল, তখন ১৯৫২ সালের ডিসেম্বর মাসে লাহোরে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনের সিদ্ধান্তে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ও নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগকে অধিভুক্ত করা হয়। তবে এই অধিভুক্তি ছিল শর্তসাপেক্ষে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ এর নামকরণ, ম্যানিফেস্টো ও কর্মসূচি থেকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে। সম্মেলনে ভাসানীর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান লীগের একটি প্রতিনিধিদল যোগ দিয়েছিল। নীতিগত মতভেদের কারণে জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগের সংগঠক নওয়াব ইফতিখার হুসাইন খানকে সম্মেলনে বহিষ্কার করা হয়। ভাসানী বলেন, জিন্নাহ লীগের সঙ্গে কোনোরূপ বিরোধ দেখা দিলে পূর্ব পাকিস্তান লীগ দলের কর্মসূচি ও ম্যানিফেস্টোর প্রতি অবিচল থাকবে। যদি কেউ আমাদের কর্মসূচিতে নাক গলাতে আসে, তাহলে কেন্দ্রীয় পার্টির সঙ্গে আমাদের অধিভুক্তির প্রশ্নটি পুনর্বিবেচনা করতে আমরা বাধ্য হবো। সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কমিটি। প্রথম সাংগঠনিক কমিটির আহ্বায়ক হন সোহরাওয়ার্দী। পরে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সেক্রেটারি জেনারেল হন মাহমুদুল হক ওসমানী। নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান হন পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি। পূর্ব পাকিস্তান লীগের সেক্রেটারি হন শেখ মুজিব। নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিখিল পাকিস্তান লীগের বৈদেশিক শাখা গঠিত হলেও পূর্ব পাকিস্তান লীগের কর্মসূচি ছিল অনেকাংশেই আলাদা। ফলে কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল নামমাত্র। প্রায় ক্ষেত্রেই স্বাধীনভাবে নিজস্ব কর্মসূচির ভিত্তিতে আন্দোলন চালাত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৫৩ সালের ১১ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান লীগের সাংগঠনিক কমিটির বৈঠকে উক্ত অধিভুক্তি অনুমোদন করা হলেও দলের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য দীর্ঘসময় বিদ্যমান ছিল। তবে অধিভুক্তির আগেই নিখিল পাকিস্তান লীগের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান লীগ একীভূত হয়ে কাজ করছিল। সোহরাওয়ার্দী সভাপতি হিসেবে স্বীকৃত হন। ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। ৫ এপ্রিল গৃহীত গঠনতন্ত্রে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচির অনুমোদনের ভিত্তিতে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তান আঞ্চলিক শাখা হিসেবে গণ্য হবে। পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান লীগ ও নিখিল পাকিস্তান লীগের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। ১৯৫৭ সালের ৮ জানুয়ারির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে পাকিস্তান সরকারের পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করার পক্ষাবলম্বন করায় মাহমুদুল হক ওসমানীকে বহিষ্কার করা হয়। সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর বক্তব্যে পরস্পরবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ভাগ হয়ে যায়। ভাসানী ন্যাপ গঠন করেন। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিব পাকিস্তান যান। সেখানেই নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন করা হয়। কিন্তু দলটি দুর্বল হয়ে পড়ে সোহরাওয়ার্দীর অবর্তমানে। পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগ শক্তিশালী করার জন্য শেখ মুজিব সচেষ্ট হন। নিখিল পাকিস্তানের অঙ্গ থাকলেও পূর্ব পাকিস্তান লীগ সব ব্যবহারিক পর্যায়ে পৃথক দল হিসেবে গড়ে ওঠে। ১৯৬৪ সালের ৯ মার্চ নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভায় দেশের দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দূর করার প্রস্তাব আনা হয়। কিন্তু সরকার তা গ্রাহ্য করেনি। ১৯৬৭ সালের ২০ আগস্ট ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির সভায় আওয়ামী লীগের বিভক্ত পিডিএমপন্থিরা ৮ দফা ঘোষণা করে। কিন্তু মূল আওয়ামী লীগ এই ৮ দফা অগ্রাহ্য করে ৬ দফার পক্ষে অবস্থান নেয়। ১৯৭০ সালের ৬ জুন ইডেন হোটেল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শেষ কাউন্সিলে শেখ মুজিবকে সভাপতি, কামারুজ্জামানকে সাধারণ সম্পাদক এবং কাজী ফয়েজ মাস্টার খান গুল, ব্যারিস্টার বরকত আলীকে সহসভাপতি করে নতুন কমিটি করা হয়। অধিবেশনে ৯৪ জন কাউন্সিলর যোগ দেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে।
১৯৭১ সালের এপ্রিলে তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের বিষয়টি সামনে আসে। রসিকতার ছলে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কামারুজ্জামান দাবি করেন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ প্রাপ্য। এই বৈঠকে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। সংক্ষিপ্তভাবে বিষয়টি এ নিবন্ধে লেখা হলেও বাস্তবে এর ইতিহাস অনেক বড়।
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)