রাত দশটার সময় প্রথম কামানের শব্দ। রাজধানীর রাস্তাতে ট্যাঙ্ক। রাতে ঘুমাতে যাবার আগে বাধা পেলাম। একটা হট্টগোল, চিৎকার, মনে হচ্ছে শনিবারের জন্য যে হরতাল ডাকা হয়েছে তারই পূর্বমুহূর্তের প্রস্তুতি। আমরা সবাই নিশ্চিত মনে ঘুমাতে গেলাম, শুলাম ঘুমালাম জেগে উঠলাম। চারদিকের নীরবতা ভেদ করে বুলেটের শব্দ। তারপর হাজার হাজার। কামানের শব্দ শুনছি ইকবাল হলের দিকে। জানিনি তখনও কী হচ্ছে। সব মেনে নেবার পর আর কি দরকার থাকতে পারে কামানের। বুঝিনি এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা হতে পারে। কেন জানি মনে হচ্ছিল ভুট্টোকে আক্রমণ করতে গিয়েছিল—তারই ফলাফল শুনছি। কারণ মোটেও বিশ্বাস হয়নি বিনা উস্কানিতে কামানের দরকার হতে পারে...
১ মার্চ ১৯৭১ : ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করতে করতেই হঠাৎ মিছিলের আওয়াজ শুনলাম। পরে জানলাম ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করেছে। অবাক লাগে, এত শোষণ করার পরও এত সাহস কেমন করে হলো। সারা ঢাকা অশান্ত। ক্রিকেট মাঠে খেলোয়াড়দের মারা হয়েছে। চিৎকার, খোদা জানে কী হবে। কাল হরতাল। মুজিবুর রহমান ন্যায়সংগত কথাই বলেছেন। দেশের জন্য চিন্তা, মোস্তফার জন্য ভাবনা। যেরকম ছেলে, হয়তো মিছিলের পুরোভাগেই থাকবে। কেন আজ ওকে একটু সাবধান করে দিলাম না। বোকার মতো বাংলা একাডেমিতে ওকে ফেলে রেখেই চলে এসেছি। কথা পর্যন্ত বললাম না। যদি ও কাল আসত। আমার কোনো আশাই কোনোদিন অপূর্ণ থাকে না। যদি এটাও হতো। ভাইয়া যদি ইতালি থেকে চলে আসত কোনো গণ্ডগোল হবার আগে।
২ মার্চ ৭১ : সারাটা দিন গণ্ডগোল হয়েছে। রাত ৮টার কারফিউ দিয়ে আবার কয়েকজনের রক্তে ঢাকা লাল রং ধরেছে—তাই চৈত্রের বুগেনভেলিয়া এত লাল হয়। কারণ প্রতিটা রক্তপাত এদিনে হয়। চিন্তা ভাইয়ার জন্য, মোস্তফার জন্য অহেতুক চিন্তা। দেশ। বাংলা। নাহ, কিছুই ভালো লাগছে না।
৩ মার্চ ৭১ : ইয়াহিয়া খান ঢাকায় পার্লামেন্টারি নেতাদের সম্মেলন ডেকেছেন। ঈশ্বর জানেন এবার শান্ত হবে না সবাই। যদি আবার আগের মতো শান্ত হয়ে যেত। সবার কোনো সংবাদ যদি পেতাম তাহলে বেশ হতো। মুজিব সবাইকে শান্তির জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
৬ মার্চ ৭১ : ২৫ তারিখ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের সম্মেলন ডেকেছে। জানি না এবার সবাই শান্ত হবে কি না। ভাইয়া কবে আসবে জানি না। মা-আব্বা ওর জন্য দুশ্চিন্তা করছেন। ও এলে একসাথে হওয়া যেত। মোস্তফা এলে পারত একদিন। ইউনিভার্সিটি বুধবার খুলবে। অনেকদিন নয় কি।
৭ মার্চ ৭১ : রেসকোর্সের ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির অধিবেশনে যোগ দেবার জন্য ৪ দফা দিয়েছেন। এসব মানলে উনি যোগ দেবেন। নির্ভেজাল সত্যি যে ইয়াহিয়া এসব মানবে না। সুতরাং পূর্ববাংলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ঈশ্বর জানেন কী হবে, কোথায় আমরা যাব। আশ্চর্য লাগে এত অরাজকতাকে কীভাবে শান্ত করবে সরকার। এর জন্য দায়ী আমাদের নেতারা। অসহযোগ আন্দোলন চলবে। আর ভাবা যায় না অথবা স্বপ্নও দেখা যায় না। ভাষণটি রেডিও থেকে প্রচারের কথা থাকলেও তা প্রচার করা হয়নি। ঢাকা বেশ চুপচাপ। সরকারি অফিস শুধু চলছে। আর সবই বন্ধ। মনে হয় অনেকেই একটা শঙ্কার আশা করছে।
১২ মার্চ ৭১ : শরীরটা খারাপ ছিল বলে একমাত্র নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ভাবিনি। বাংলাদেশ। আজকাল এ চিন্তাও করি না—করব কি? ভেবে পাই না বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী? স্বাধীন বাংলা আমরা সবাই চাচ্ছি—অথচ যাদের মাধ্যমে পেতে চাচ্ছি তারা বলছে সংহতিতে তারা বিশ্বাসী। সুতরাং আমরা তো আর কথাতে স্বাধীনতা আনতে পারব না—অতএব কোনো চিন্তা নেই। একমাত্র চিন্তা কবে আবার সব স্বাভাবিক হবে। ভিয়েতনাম আমরা হতে চাই না—আমরা বাংলার মানুষেরা শুধু চাই শান্তিতে থাকতে। একদম শান্তিতে ভরা বাংলাদেশ।
১৫ মার্চ ৭১ : প্রেসিডেন্ট আজ আসছে। এর পরই বোঝা যাবে কী হতে পারে পাকিস্তানের অথবা একা বাংলাদেশের। ইয়াহিয়া খান বোকা হলে এর পরও কোনো গোলমাল করতে চাইবে—না হলে নয়। বরং মুজিবের সব মেনে নিয়ে দেশকে কিছুদিনের জন্য স্বাভাবিক হতে দেবে। তারপর জনতার ওপর যখন আস্থা হারাবে মুজিব, তখনই হয়তো কিছু একটা করবে। কিন্তু আর পারবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের লোকেরা সব বুঝতে শিখেছে।
১৬ মার্চ ৭১ : ইয়াহিয়া খানের সাথে আজ বেলা এগারোটার সময় মুজিব কথা শুরু করেছে প্রেসিডেন্ট ভবনে। দেখা যাক কী হয়।
১৯ মার্চ ৭১ : আলোচনা চলছে। সব আগের মতো। অসহযোগ আন্দোলন চলছে। দ্বিপক্ষীয় আলোচনা (মুজিব-ইয়াহিয়া) চলছে। এরপর কোনোরকম সমঝোতায় আসা একান্তভাবে দরকার।
২১ মার্চ ৭১ : ভুট্টো আজ ঢাকায় এসেছে। জানা অথবা বোঝা যাচ্ছে না ঠিক কী হবে। মোট কথা একটা কিছু সমঝোতায় আসা একান্তভাবে দরকার। আর কতদিন অসহযোগ আন্দোলন। হয় স্বাধীনতা, নয় কোয়ালিশন করতে হবে।
২৫ মার্চ ৭১ : রাত দশটার সময় প্রথম কামানের শব্দ। রাজধানীর রাস্তাতে ট্যাঙ্ক। রাতে ঘুমাতে যাবার আগে বাধা পেলাম। একটা হট্টগোল, চিৎকার, মনে হচ্ছে শনিবারের জন্য যে হরতাল ডাকা হয়েছে তারই পূর্বমুহূর্তের প্রস্তুতি। আমরা সবাই নিশ্চিত মনে ঘুমাতে গেলাম, শুলাম ঘুমালাম জেগে উঠলাম। চারদিকের নীরবতা ভেদ করে বুলেটের শব্দ। তারপর হাজার হাজার। কামানের শব্দ শুনছি ইকবাল হলের দিকে। জানিনি তখনও কী হচ্ছে। সব মেনে নেবার পর আর কি দরকার থাকতে পারে কামানের। বুঝিনি এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা হতে পারে। কেন জানি মনে হচ্ছিল ভুট্টোকে আক্রমণ করতে গিয়েছিল—তারই ফলাফল শুনছি। কারণ মোটেও বিশ্বাস হয়নি বিনা উস্কানিতে কামানের দরকার হতে পারে।
২৬ মার্চ ৭১ : আজিমপুরের দুটো ফ্ল্যাটে পাকিস্তানি মিলিটারি ঢুকেছিল। সারাদিন কারফিউ ছিল। মাঝে মাঝেই মেশিনগানের শব্দ আর পাঞ্জাবি মিলিটারির চলাচলের শব্দ। মাঝে কয়েকজন লোককে কলোনির ভেতর দিয়ে গোরস্তানের দিকে পালাতে দেখছি। কেন জানি ওদের অসহায় মনে হচ্ছিল না। ক্ষুদিরাম সূর্য সেন যেন ওরাই। নেতাজি সুভাষ বোসের শিষ্য। ওরা অমৃতের সন্তান, ওদের মৃত্যু নেই। চারদিকে আগুন, একটা বাংলাদেশের ফ্ল্যাগও কোথাও নেই।
২৭ মার্চ ৭১ : কারফিউ কিছুক্ষণের জন্য ছেড়েছে। বাসার নিচ দিয়ে অনবরত কাফেলা চলছে। বস্তির পর বস্তি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ওদের নিঃস্ব করা হয়েছে। ঢাকা ছেড়ে ওরা চলে যাচ্ছে। কোথায় যাবে তাও অনেকে বলতে পারে না। ওদের মুখেই শুনলাম রাস্তায় রাস্তায় নাকি লাশ পড়ে রয়েছে। বাসায় পানি নেই। প্রচণ্ড গরম। একটা হাহাকার ভাব চারদিকে। হাসি নেই, কান্নাও নেই। শুধু যেন একটা প্রশ্ন, বিংশ শতাব্দীতে এ কোন যুগে গেলাম। রাজ্য জয়ের অদ্ভুত নিদর্শন। রাতে বেশ কয়েকবার ফায়ারিংয়ের শব্দ শুনেছি। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা একেবারে ম্যাসাকার করে ফেলেছে।
কেউ একজন বলল, বটগাছটা নাকি উপড়ে ফেলেছে। কতজন মরেছে তার কোনো হিসাব নেই।
২৮ মার্চ ৭১
ভারতের রেডিওতে বাংলাদেশের অত্যাচারের কথা বলা হয়েছে। লোকসভাতে এ নিয়ে কথা হবে আগামীকাল। ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
২৯ মার্চ ৭১
রেডিও ঢাকা থেকে বলা হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানকে ধরা হয়েছে। জানি না কতদূর সত্যি।
৩০ মার্চ ৭১
কাল রাতে আকাশবাণী থেকে বলা হয়েছে মুজিবুর রহমান বিদেশি একটা দূতাবাসে রয়েছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ধরেছিলাম। সেখানেও বলল মুজিবুর রহমান ভালো। টিক্কা খানকে প্রেসিডেন্ট হাউসে যেয়ে মারা হয়েছে। এও জানি না কতদূর সত্যি। আমার কথা টিক্কা খানকে মারলেই কি সব শান্ত হবে। প্রত্যেকটা পাঞ্জাবি এক একটা টিক্কা খান, কি তার চেয়েও দুর্ধর্ষ। সবাই এক সমান। আমাদের ওরা সম্পূর্ণভাবে না মেরে শান্তি পাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক অধ্যাপক নাকি মারা গিয়েছেন।
৩১ মার্চ ১৯৭১
বাসা ছেড়েছি। কোথায় যাব জানি না। আপা ঢাকায় থাকবেন। সরকারি চাকরি—জমানো কোনো টাকা নেই, সুতরাং চাকরি না করে উপায়ও নেই। আমাদের বাড়িতে (দাদার বাড়ি) পাঠিয়ে দিলেন। চলে গেলাম। একদম দেশের বাড়ি। পথে পথে শুধু মানুষ, সবাই পালাচ্ছে। অনেকে জানে না কোথায় যাবে। কিছু রিকশায়, কিছু হেঁটে, কিছু বাসে করে রাতে বাড়িতে পৌঁছেছি। সারাদিনের ক্লান্তির পর নিরাপদ আশ্রয়ে নিজেকে দোষী মনে হয়েছে। অনেকে যখন মৃত্যুর সাথে করছে লড়াই, আমরা তখন বাঁচার জন্য নিরাপদ হতে গেলাম।
১ এপ্রিল ১৯৭১
একমাত্র আকাশবাণীর খবর শুনে কিছু বুঝি। গ্রামে গুজবের শেষ নেই। নতুন নতুন লোক আসছে, যা নয় তার চেয়ে অনেক বেশি বলছে বাহাদুরি নেবার জন্য। অথচ ওরা বোঝে না গুজব অন্তত এখন ছড়ানো উচিত নয়। সবাইকে কিছুটা আশ্বাসের কথা শুনিয়ে শান্ত করা দরকার। গ্রামে কেউ বিশ্বাস করে না শেখ সাহেব ধরা পড়েছেন। ওদের মনের সেই বিশ্বাসই ওদের বাঁচিয়ে রেখেছে। তাই থাকুক—এটাই সবচেয়ে বড় আশ্বাস।
২ এপ্রিল ১৯৭১
ভাবি, এর শেষ কোথায়। একে সব অস্ত্র ব্যবহার করেছে পাকবাহিনী। জিনজিরাতে প্লেন থেকেও বোম্বিং করে মানুষ মেরেছে। কী করে আমরা পারব, যেখানে আকাশ থেকে আক্রমণ হচ্ছে! ইকবাল হলের ছেলেরা মরেছে, স্যাররা মারা গেলেন, রোকেয়া হলেও গিয়েছিল মিলিটারি। শহীদ মিনার ধুলার সাথে মিশিয়ে দিয়ে মসজিদ করা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই মসজিদ ভেঙে আবার বাঙালি একদিন এটাকে শহীদ মিনারই করবে। সুতরাং ধর্মকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা উচিত না। গ্রামকে গ্রাম পোড়াচ্ছে। মুক্তি হবে—আমরা কাপুরুষরা তা বেঁচে থেকে ভোগ করব। ওদের পায়ে নত হয়ে তাই শ্রদ্ধাঞ্জিল দিতেও লজ্জা পাচ্ছি। আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন পাকিস্তানকে সাহায্য দেয়ার কথা ভাবছে না। বাংলাদেশের অত্যাচার সম্বন্ধে ওরা অবগত হতে চায়।
৩ এপ্রিল ১৯৭১
এত অত্যাচার চেঙ্গিস খানের পর আর কী হয়েছে? গ্রামে বসেও সারাদিন মেশিনগান আর কামানের শব্দ পাই। একটা আতঙ্ক সবসময় কাজ করে, মিলিটারি আসবে কি না। গ্রামে অভাব। শহর থেকে অনেক লোক আসছে। কারও হাতে নগদ টাকা নেই। তেল নেই, চিনি নেই।
৪ এপ্রিল ১৯৭১
নজরুল ইসলাম আজ হাতিরদিয়া বাজার দিয়ে পালালেন। কোনদিকে যাবেন সে ব্যাপারে নাকি কারও কোনো কথার জবাব দেননি। তাজউদ্দীন, মোশতাক আগেই পালিয়েছেন। বাংলাদেশের চাঁদ এত আলো পাচ্ছে কোথা থেকে?
এপ্রিল, ৭১ (গ্রামের বাড়িতে বসে)
একে একে সংগ্রামময় দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। সবাই উত্তেজিত। সাধারণ মানুষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছে আমরা কী পেলাম। পাওয়ার বিষয়টি এতদিন ১০% মানুষও জানত না। এবার এই যুদ্ধ সবাইকে বুঝতে শিখিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের শোষণ করে এসেছে এবং তাই করবে এটা বুঝতে পেরেছে বলেই আমাদের এবারের স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল হবেই। আমি নাইবা পারলাম স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে, কিন্তু হাজার হাজার বাঙালি ছেলে যেভাবে প্রাণ দিচ্ছে তার জন্যই তো আমার প্রাণ গর্বে ফুলে উঠছে যে আমি একজন বাঙালি। ১৯৪৭ সালের পর আমরা ওদের কাছ থেকে কী পেয়েছি? ১৯৫২ সালেই আমাদের (স্বাধীনতার মাত্র পাঁচ বছর পর) ভাষার জন্য আমাদের প্রাণ দিতে হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও আমরা আমাদের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রাণ দিয়েছি। প্রাণ দিয়েই প্রাণের ভাষা পেয়েছি। সৃষ্টি হয়েছে আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারি।
১৯৬২ সালে শিক্ষানীতি বর্জনের দাবিতে আবার কয়েকটা সোনার প্রাণ নষ্ট হয়েছে।
১৯৬৯ সালে হল ছাত্র আন্দোলন।
তবু আমরা এক পাকিস্তানে বিশ্বাসী ছিলাম। চেয়েছি স্বাধিকার। বাঁচার মতন বাঁচতে চেয়েছি। পাঁচশালা পরিকল্পনার সব টাকা আসে পূর্ববাংলার পাট আর চা রপ্তানি থেকে। অথচ টাকা সব খরচ করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। মঙ্গলা বাঁধ দিয়ে মরুভূমিকে করা হয়েছে সজীব অথচ পূর্ববাংলায় আশ্রয় কেন্দ্রের অভাবে এক রাতে মারা যাচ্ছে পাঁচ লক্ষ লোক। প্রতি বছর বন্যাতে ঝড়ে আমরা মরছি। ওদের সাথে আমাদের চলা হবে না এ কথাটা তারা এবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে আমার মনে হচ্ছে এই যুদ্ধের প্রয়োজন ছিল। তা না হলে আমাদেরও চোখ খুলত না। ৭ কোটি বাঙালি আজ অন্তত বুঝতে পারছে আমরা প্রকৃতপক্ষে কী চাচ্ছি! স্বাধীনতা ছাড়া ওদের সাথে আর কোনো সমঝোতা নয়। অসহযোগ আন্দোলনেও অনেকের মতো আমারও মনে হয়েছিল একটা সমঝোতা, কিন্তু এখন আর তা চাচ্ছি না। দলে দলে লোক ভারতে যাচ্ছে। মুক্তিসেনা হচ্ছে। জয় আমাদের হবেই। দেশে মুসলিম লীগ আর জামায়াতদের দাপট বাড়ছে অত্যন্ত বেশি। সবাইকে এর শাস্তি পেতে হবে। পাঞ্জাবি মিলিটারিদের ক্ষমা করা হলেও দেশের রাজাকারদের ক্ষমা করা হবে না। একই দেশ, একই কৃষ্টি এবং একই ভাষাভাষী যখন সর্বনাশ করে তখন তাদের কী করে ক্ষমা করা যায়? জনসমক্ষে এদের হত্যা করতে হবে। মাঝে মাঝে গভীর রাতে বাংলার আকাশের দিকে চেয়ে থাকি। হিমেল হওয়া বাতাসের কান্না আকাশের চাঁদ কদমের সুবাস ঝিঁঝির ডাক—এত সুন্দর বাংলা আমার। কার প্রাণ চায় বাঙালির জীবনে অশান্তি আনতে। গ্রামবাংলা নিয়েই আমরা সুখী হয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। ঝিঁঝি ডাকা রাতে কান পেতে ঝিঁঝি ডাক শুনতে শুনতে কেঁদেছি—কেন বাংলার মাটিতে এত রক্ত। সোনার বাংলাতে এত লাল পলাশের রং কেন! আর সেই লাল রক্ত যে আমার প্রাণেও আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। চলে যেতে ইচ্ছা হয় মুক্তিবাহিনীতে। বাংলার শ্যামলিমাকে আবার ফিরিয়ে এনে সেই শহীদ মিনারের গায়ে মাথা রেখে প্রাণ ভরে যদি কাঁদতে পারতাম। আমি অতি সাধারণ। আমি তাই কাঁদতে চাই। বাংলার কান্না আমার আর সহ্য হচ্ছে না। তোমরা আমাদের ক্ষমা করো।
১২ এপ্রিল ১৯৭১
বিপ্লব ভরা দিন এমনি করেই এগিয়ে যাবে। তোমাদের চলার পথ চোখের জলে ভিজিয়ে অমঙ্গল করে দেব না। তোমরা আগাও আমরা কাপুরুষ তবু আমরাও বাঁচতে চাই স্বাধীনভাবে স্বাধীন রাষ্ট্রে।
১৭ এপ্রিল ১৯৭১
আজ বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ নিয়েছে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে। তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট। জানি না মেহেরপুরে একটা ঘরও বোমার হাত থেকে রেহাই পাবে কি না। তবুও ওরা শপথ নিয়েছে। স্বীকৃতি পেলে হয় কোনো বড় দেশের।
২১ মে ১৯৭১
ঢাকার বাসায় ফিরে এলাম ২০ দিন পর। মনে হচ্ছে এত নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে কেন বোকার মতো গিয়েছিলাম। এখানে থেকে মরতেও ভয় নেই। সবাই একসাথে আছি। আব্বা একা থাকতেন সেটাই বেশি ভয় ছিল।
৬ মে ১৯৭১
পঙ্গু জীবনের সমাপ্তি কবে কে জানে। বয়স্ক ছেলেরা ঘরে বসে রয়েছে। মেয়েরা জানালা দিয়ে তাকাতে চাইছেন। আমাদের জেনারেশন হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা হারিয়ে যাচ্ছি প্রবল পঙ্গুতার ভিড়ে। কোথাও ঠাঁই নেই। শান্তি নয় স্বাধীনতা। একমাত্র চিন্তা, একমাত্র ভাবনা। মরছি আরও মরব।
২১ জুন ১৯৭১
এক একে শহরগুলো হাতছাড়া হচ্ছে। অনেক মৃত্যুর খবর শুনছি। আশেপাশে অনেক খবর। বিচ্ছিন্নভাবে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করছে। মারছে এবং মরছে।
২২ জুন ১৯৭১
২৮ তারিখে সেনাপতির ভাষণ আছে। দেখি ছক্কু মিয়া কী বলে।
২৮ জুন ১৯৭১
ছক্কু মিয়ার ভাষণ আজ হলো। সেই পুরোনো কথা। সব দোষ পূর্ববাংলার লোকেদের। সেনাবাহিনী উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছে।
৫ জুলাই ১৯৭১
আমাদের বাসার উল্টোদিকে নিউপল্টন লাইনে খসরুর বাসা। প্রায় প্রতি রাতেই ওদের বাসায় মিলিটারি আগুন লাগায়। সেই আগুন দেখে আশেপাশের সবাইকে ভয় পাইয়ে দেয়াই আর্মির কাজ। কারণ খসরু ইন্ডিয়াতে এবং যতদূর সম্ভব কোনো সেক্টরে যুদ্ধ করছে।
২১ জুলাই ১৯৭১
এখন মা বাজার করেন। ভাইয়া অথবা আব্বাকে বাজারে পাঠানো হয় না। আর আমাদের পক্ষে তো যাওয়াই সম্ভব নয়। পথ থেকে তুলে নিয়ে যাবে।
৩ আগস্ট ১৯৭১
মুক্তিবাহিনী ঢাকা ছাড়বার জন্য বলছে। কী লাভ ঢাকা ছেড়ে। ছোট্ট পূর্ববাংলা। সব জায়গাতে একই কথা। তার চেয়ে বরং এখানে থেকেই মরে যাব, সেই ভালো। সরাসরি মুক্তিবাহিনী হতে না পারাটাই একটা লজ্জা, তাছাড়া কোন লজ্জায় বাঁচার জন্য ছুটে বেড়াব। স্বাধীনতা সংগ্রামে নয়তো ঘরে বসেই মরব। সেই ভালো। অনেকদিন বেঁচেছি—অনেক দেখাও হলো—আর বেঁচে থেকে যদি কোনো কাজেই না আসতে পারি তাহলে কোনো লাভ নেই বেঁচে থেকে।
৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
মুক্তিযুদ্ধে যাইনি সত্যি, কিন্তু প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে একটা বিরুদ্ধ শক্তির সাথে। প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য অথবা প্রয়োজনীয় কাজে বাইরে যাওয়া দূরে থাক, কারও মারা যাবার খবর শুনলেও বের হওয়া যায় না। ভারতে যাব, আমাদের কেউ নেই। তাছাড়া আব্বার এমন কোনো টাকাও নেই যে সেটা হাতে নিয়ে চলে যাব। চাকরি না করলে কালকে খাবার মতো কিছু থাকবে না।
৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
ইউনিভার্সিটি গিয়েছিলাম। এমনিতেই ঘুরতে। ঢাকা আগের মতো নেই। চারিদিক শান্ত। যদিও পাক সরকার ঢাকাকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে।
১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
হঠাৎ করে কোনো ফেরিওয়ালা দেখলে মনে হয় বোধহয় মুক্তিবাহিনী। না চাইলেও পানি খেতে দিই, যদি মুক্তিবাহিনী হয়ে থাকে, একটু পানি তো খাওয়ালাম।
১১ অক্টোবর ১৯৭১
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বোম ফুটেছে। মুক্তিবাহিনী মেরেছে।
২৫ অক্টোবর ১৯৭১
সেই দিনগুলোকে ফিরে পেতে ইচ্ছা করে। আগের মতো করে, আগের সুরে আমরা কি আর কথা বলতে পারব।
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
রাত তিনটা পাঁচ মিনিটে প্রচণ্ড শব্দে জেগে উঠলাম। শুনলাম সাইরেনের আওয়াজ। বিশ্বাস হলো না এয়ার অ্যাটাকের তলে পড়লাম আমরা। তারপর জেগে কাটালাম। বোম্বিং হলো। রাতটা না ঘুমিয়ে কাটালাম।
৪ ডিসেম্বর ১৯৭১
এয়ারপোর্ট পুরো বিধ্বস্ত হয়েছে। পাকিস্তানি জাহাজ আর উড়তে পারবে না। ঈশ্বর কি সত্যি মুখ তুলে তাকাবে। আমরা কি সত্যিই মুক্ত হবো। অনেক আতঙ্কের মাঝেও অনেক সান্ত্বনা। সারাদিন প্রচুর বোম্বিং হয়েছে।
৫ ডিসেম্বর ১৯৭১
আজকের দিনটা একবারও সাইরেন পড়েনি। মনে হচ্ছে আমরা যেন নতুন সূর্যের স্বপ্ন দেখতে পারি। মনাক্কার বিয়ে আজকে।
৯ ডিসেম্বর ১৯৭১
পাকিস্তানি আর্মি হেলিকপ্টার থেকে বোম্বিং করেছে। এতিমখানার ওপর। অনেক শিশু মারা গিয়েছে। মনে হচ্ছে ওরা আমাদের মারবে। বেসামরিক লোকদের ওপর ইন্ডিয়ানরা বোম্বিং করছে না বলেই ওরা এ পন্থা বের করেছে। ঈশ্বরের কাছে কি ন্যায়ের জয় নেই। ওদের ধ্বংস কতদিনে হবে। দিন কি আজও ফুরাবে না? শুধু খিচুড়ি খাচ্ছি। বাসায় পানি নেই।
১০ ডিসেম্বর ১৯৭১
অনেক লোক শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। ভয়ে নয়—এক দৈত্যের আতঙ্ক থেকে রেহাই পাবার জন্য। রাতে আঁধারে বেসামরিক লোকদের ওপর পাকবাহিনী বোমা ফেলেই চলেছে। নিয়াজির পতন কতদিন। রাও ফরমান আলির সারেন্ডার করবার ইচ্ছা সত্ত্বেও নিয়াজির জন্য পারছে না।
১২ ডিসেম্বর ১৯৭১
আজিমপুরের সাতটা বাড়ি আর্মিরা নিয়ে নিয়েছে। ওরা সিভিলিয়ন এলাকায় থাকবে—যাতে বোম্বিং ভুল জায়গায় হয়। কাল হয়তো আমরাও বাসা ছাড়ব।
১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
টুকুন খালার বাসায় চলে এসেছি। নাসিমরাও এসেছে। দেখি বাঁচতে পারি কি না। বাঁচার জন্য যে এত স্বাদ তা আগে বুঝিনি। আজ আমারও বারবার বলতে ইচ্ছা করছে ভালোবেসে হায় মিটিল না স্বাদ—এ জীবন এত ছোট কেন?
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১
মৃত্যুর মুখোমুখি কাটালাম। রায়ট হলো। বিহারিরা শেষবারের মতন বাঙালিদের মেরে নিল। আমরা ওদের ক্ষমা করব না। বাঙালিরা মৃত্যু পর্যন্ত বিহারিদের ঘৃণা করতে শিখুক—এ প্রার্থনা করছি। ওদের যেন ক্ষমা না করি।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
এরই নাম বোধহয় স্বাধীনতা। স্বাধীনতার আনন্দ যে এত সুন্দর আগে জানতাম না। হাসতে ইচ্ছা করছে বারবার। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে সবাইকে ‘আমরা স্বাধীন’। কোনো কষ্টই করিনি স্বাধীনতার জন্য। তবু নিজেকে এত মুক্ত মনে হচ্ছে কেন? বাংলার হাসি আজ আকাশে বাতাসে। নিয়াজি সারেন্ডার করেছে। সারেন্ডার পত্রে সাইন হয়েছে ৫টা ১ মিনিটে। আমরা স্বাধীন। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। ইয়াহিয়া ভুট্টো আজও বিশ্বাস করতে পারছে না পূর্ব পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে। সবাই খুশি।
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
চারিদিকে হাসি। বেলা ২টার সময় রেডিও বাংলাদেশ, ঢাকার স্টেশন থেকে অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়েছে। সন্ধ্যা ৬-৩০ মিনিটে টিভি উদ্বোধন করেছে মেজর হায়দার (মুক্তি)। আমার চোখে সে দেবতা।
১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১
রাস্তায় রাস্তায় জয় বাংলা ধ্বনি। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী একসাথে রাস্তায় চলাচল করছে। পথে অনেক লাশ দেখলাম। মুনীর চৌধুরীকে হত্যা করেছে আলবদর বাহিনী। আরও অনেক বুদ্ধিজীবীকে মেরেছে। স্বাধীনতার জন্য অনেক রক্ত গেল।