কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৬ মার্চ ২০২৪, ০২:২০ এএম
আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৪, ১০:২৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আফসান চৌধুরীর নিবন্ধ

ইতিহাস বনাম স্মৃতিস্তম্ভ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

''একেবারে ব্যক্তিগত একটা অভিজ্ঞতা থেকে বলি—আমি তো বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়াই। সেখানে আমার ছাত্রছাত্রীদের প্রায় সময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের তথ্য সন্ধান করতে বলি। সে ক্ষেত্রে একটা অ্যাসাইনমেন্ট তাদের করতে হয়ে থাকে। সেটা হলো তাদের বাড়ির মানুষ বা আত্মীয়স্বজনের অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করা। এ প্রক্রিয়াটা যখন চালু ছিল—তখন আমি দেখেছি যে, ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই অনেক কিছু জানতে পেরেছে। এবং ইতিহাসের সঙ্গে তাদের একটা সম্পৃক্ততা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এবার এসে আমার ছাত্রছাত্রীরা জানাল যে, তাদের পক্ষে এটা করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ তাদের বেশিরভাগেরই যে আত্মীয়স্বজন একাত্তরে ছিল, তারা এখন বেঁচে নেই বা যারাও আছে তাদের সঙ্গে এখন আর কথা বলার মতো অবস্থা নেই।

সেটাই স্বাভাবিক। কারণ একাত্তরে আমার বয়স ছিল আঠারো-উনিশ, আমার চেয়ে বয়সে বড় মানুষ যারা, তারা তো বেঁচে না থাকারই কথা। আমার বাবা কিংবা তার প্রজন্মের মানুষরা তো আর নেই...''

মার্চ মাস এলেই গণমাধ্যমে আমার ব্যস্ততা বেড়ে যায়—কারণ অনেকেই ফোন করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে জানার জন্য। কয়েক দিন ধরে কয়েকটা টেলিভিশন চ্যানেল থেকে আমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার চেষ্টা করছিল, যাদের আমি ফিরিয়ে দিয়েছি। তারা বলেছে যে, আমি স্টুডিওতে যেতে না চাইলে, তারা নিজেরাই বাসায় আসবে। আমি সেটাতেও রাজি হইনি। পরে একজন যখন বলল যে, বিষয়টা হচ্ছে—বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ করে গণহত্যার স্মৃতিসৌধগুলো রক্ষা করার যে কাজ আছে সেটা ঠিকমতো করা হচ্ছে না এবং তার ফলে সৌধগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি তখন বললাম—গণহত্যার স্মৃতিস্তম্ভগুলো যে আছে, সেগুলোর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চার সম্পর্কটা কী? ভদ্রলোক তখন বললেন, ‘তাহলে আমাদের ছেলেমেয়েরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে জানবে কী করে?’

আমি মনে করি, এখানটাতেই আমাদের সমস্যা। একেবারে ব্যক্তিগত একটা অভিজ্ঞতা থেকে বলি—আমি তো বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়াই। সেখানে আমার ছাত্রছাত্রীদের প্রায় সময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের তথ্য সন্ধান করতে বলি। সে ক্ষেত্রে একটা অ্যাসাইনমেন্ট তাদের করতে হয়ে থাকে। সেটা হলো তাদের বাড়ির মানুষ বা আত্মীয়স্বজনের অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করা। এ প্রক্রিয়াটা যখন চালু ছিল—তখন আমি দেখেছি যে, ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই অনেক কিছু জানতে পেরেছে। এবং ইতিহাসের সঙ্গে তাদের একটা সম্পৃক্ততা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এবার এসে আমার ছাত্রছাত্রীরা জানাল যে, তাদের পক্ষে এটা করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ তাদের বেশিরভাগেরই যে আত্মীয়স্বজন

একাত্তরে ছিল, তারা এখন বেঁচে নেই বা যারাও আছে তাদের সঙ্গে এখন আর কথা বলার মতো অবস্থা নেই। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ একাত্তরে আমার বয়স ছিল আঠারো-উনিশ, আমার চেয়ে বয়সে বড় মানুষ যারা, তারা তো বেঁচে না থাকারই কথা। আমার বাবা কিংবা তার প্রজন্মের মানুষরা তো আর নেই।

এ কথাটাই বারবার আমি বলেছি যে, একটা সময় আসবে যখন স্মৃতি রক্ষা করার আর কেউ থাকবে না এবং আমরা সেই সময়টায় এসে উপস্থিত হয়ে গেছি স্বাধীনতার এই ৫৩ বছর পরে এসে। অতএব আমরা আর মার্চকে মনে রাখার চেষ্টা করছি না। আমরা স্মৃতিস্তম্ভগুলোকে মনে রাখার চেষ্টা করছি এবং এ সংকটটা আমাদের সর্বব্যাপী ছড়িয়ে গেছে।

মার্চের কোন কোন স্মৃতি আমরা মনে রাখিনি? যেমন আমি মনে করি, আমরা ঢাকার পালপাড়াকে মনে রাখিনি। ঢাকা শহরের মাঝখানে অবস্থিত একটা নিম্নবর্গের হিন্দু—মেথর, দারোয়ান, মালি ইত্যাদি মানুষের বস্তি পালপাড়াকে পাকিস্তান আর্মি পুড়িয়ে দিয়েছিল। যেখানে এখন হোটেল সোনারগাঁও। এ ইতিহাসকে কি কেউ রক্ষা করার চেষ্টা করেছে? সোনারগাঁও হোটেলটা কি একটা স্মৃতিস্তম্ভ? গণহত্যা তো সেখানেও হয়েছে। আমরা কি সেটা মনে রেখেছি?

টিভি থেকে যে ভদ্রলোক ফোন করেছিল, সে বলেছে—একাত্তরের স্মৃতিস্তম্ভ রক্ষায় নাকি ৮ কোটি টাকার প্রকল্প আছে, কিন্তু কেউ স্মৃতিস্তম্ভগুলোর দেখাশোনা করেনি, সেই টাকাগুলো চুরি হয়েছে ইত্যাদি। আমি বলছি যে, বাংলাদেশের কোনো সরকারি প্রকল্পে চুরি হয় না! সেটা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ প্রকল্পই হোক আর অন্য যে কোনো প্রকল্পই হোক। প্রকল্প হবে আর চুরি হবে না, এটা কী করে সম্ভব? এটা তো আমাদের জাতিগত বা রাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্যেই পরিণত হয়েছে। অতএব আমরা চুরি করবই। সেটা ধর্মীয় কিছু হোক, নিজের বাপের শ্রাদ্ধ হোক বা যে কোনো কিছু হোক। এখানে ইতিহাসচর্চার সঙ্গে চুরির কোনো সম্পর্ক নেই, দক্ষতার অভাবেরও কোনো সম্পর্ক নেই। আর স্মৃতি সংরক্ষণের কথা যদি বলা হয়, তাহলে আমরা ওই স্তম্ভগুলো থেকে আসলে কী জানতে পারব! আমরা যে কেউ বানিয়ে যদি বলি এখানে পাঁচ হাজার লোক মারা গেছে—কেউ তার বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারবে? কিংবা আমি যদি বলি এখানে দুজন মারা গেছে—তবুও কেউ কিছু বলতে পারবে? কারণ ওখানে যে মানুষগুলো বেঁচে ছিল, যারা দেখেছে—তাদেরই তো আমরা কোনোদিন জিজ্ঞাসা করিনি। আমরা তো স্মৃতি সংরক্ষণ করতে চাই না। আমরা স্তম্ভ সংরক্ষণ করতে চাই এবং এ দুটোর মধ্যে যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে, সেটাও আমরা বুঝতে চাই না। আমরা শুধু প্রতীকগুলোকে রক্ষা করতে চাই, তথ্যগুলোকে রক্ষা করতে চাই না এবং এ সংকটে আমাদের ইতিহাসচর্চা সবচেয়ে বেশি ভুগছে। এর কারণ হচ্ছে, আমাদের ইতিহাসচর্চার একটা বড় প্রবণতা হলো, যে-ই ক্ষমতায় থাকে অর্থাৎ আমরা যেটাকে রুলিং ক্লাস বলি, সেই রুলিং ক্লাস তাদের বৈধতা নেয় ইতিহাসের কাছ থেকে। সেটা একাত্তরের ইতিহাস হোক আর যে ইতিহাসই হোক। সে ক্ষেত্রে তার তো তথ্য মনে রাখার দরকার নেই। তার তো প্রতীক দরকার। এখন বাংলাদেশে এই বায়ান্ন-তিপ্পান্ন বছরে বাংলাদেশ সরকার, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, জাতীয় জাদুঘর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আরও এত এত বিশ্ববিদ্যালয়—এত প্রতিষ্ঠান মিলে গণহত্যার একটা জরিপ করতে পারত না? আমি যে একটা পুরো জেলায় জরিপ করেছি—সাধারণ মানুষ নিজের আগ্রহে এসে আমাদের সহায়তা করেছে। আমাদের খরচ হয়েছিল মাত্র আড়াই লাখ টাকা। এত কম খরচে আমি বা আমার দল কীভাবে জরিপ করলাম? কারণ কেউ কোনো পয়সা চায়নি। তাহলে আমি বা আমার সেই দলটা যদি করতে পারি, তাহলে সরকার করতে পারত না? এত যে প্রতিষ্ঠান আছে, এত যে ব্যাংক, ব্যবসায়ী আছে, এতকিছু আছে বাংলাদেশে—তারা করতে পারত না? কিন্তু তারা তো করতে চায় না। সেই বাস্তবতাকে আমরা স্বীকারও করছি না যে, একাত্তরকে আমরা ভুলতে চাই। আমরা যদি একাত্তরকে ভুলে একাত্তরকে যদি বড় বড় দশটা-বারোটা প্রতীকে পরিণত করতে পারি এবং সেটাকে সামনে ধরে রাখতে পারি, তাতেই খুশি। আমরা সেটা থেকে যে যার মতো, যখন যেমন দরকার ব্যাখ্যা করে নেব। অর্থাৎ আমরা তথ্যমুক্ত একাত্তরের ইতিহাস চাইছি এবং এখন সেটাতে আমরা সফল হয়ে গেছি। বায়ান্ন-তিপ্পান্ন বছর ধরে তথ্য সংগ্রহ না করার পর আমরা এমন একটা পর্যায়ে এসে গেছি, যখন যারা তথ্য জানে তারা আর বেঁচে নেই। অতএব আমাদের যে উদ্দেশ্য—সে উদ্দেশ্যটা সফল হয়েছে, আমরা ইতিহাসটা ভুলতে সক্ষম হয়েছি। আর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রত্যেক দল তাদের যার যার স্বার্থের মতো করেই ইতিহাস নির্মাণ করতে চাইবে। কিন্তু ইতিহাসে জনগণের ভূমিকা কেউ বলবে না, বলতে চায় না। কারণ এতে কারও লাভ নেই। আর যেসব শিক্ষক বিলেত-আমেরিকায় গিয়ে পিএইচডি করে আসে এবং বই প্রকাশ করে—তাদের সেই বই দেখলে বোঝা যায় যে, তারা কতটুকু তথ্য সংগ্রহ করেছে। তারা আসলে লাইব্রেরি উপযোগী বই করে এবং তাদের জন্য যেটা সুবিধাজনক অর্থাৎ তাদের যার যার লাইনের যে বইগুলো আছে, সেগুলোই শুধু দেখে। সেগুলোতেও যেসব তথ্য সংগৃহীত হয়েছে, সেটাও সঠিক কি না তাও তো দেখা দরকার। সেই তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে আছে। কিন্তু আমাদের তো অত জেনে কাজ নেই—আমাদের কথা হচ্ছে, ভাই সাধারণ মানুষের ইতিহাস বাদ দাও, তথ্য বাদ দাও, ওগুলো মরে গেলে বেঁচে যাই। তার চেয়ে বরং আমার দল, আমার গোষ্ঠী, আমার গ্রুপের ইতিহাসটা বল—আর প্রতীক চর্চা করো, স্তম্ভ চর্চা করো, মনুমেন্ট চর্চা করো, দিবস চর্চা করো, প্রকৃত তথ্যের দরকার নেই।

এই পর্যায়ে এসে ইতিহাস নিয়ে কথা বলারই কোনো মানে হয় না। যেখানে তথ্যই সংরক্ষণ করতে চাই না, আমাদের আবার ইতিহাস কী হবে।

লেখক: সাংবাদিক, শিক্ষক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পলাতক ফ্যাসিবাদী শক্তিকে জাতি আর গ্রহণ করবে না : শিবির সভাপতি

নরসিংদীতে জুট ব্যবসা নিয়ে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষ

জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া সংস্কার চাপিয়ে দেওয়া যাবে না

৫ আগস্ট বিপ্লব নয়, দেশে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে : বুলু

এবার ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পেল বিজিবি-কোস্টগার্ড

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে নির্বাচনই একমাত্র পথ : খন্দকার মুক্তাদির

পয়লা অগ্রহায়ণে ঢাবিতে নবান্ন উৎসবের আমেজ

গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে হাসিনা ছেড়ে দিত না : মজিবুর রহমান‌

শেখ হাসিনা বিদেশে বসে নতুন নতুন ষড়যন্ত্র করছে : গোলাম পরওয়ার

টিকটকার মুন্নিকে ধর্ষণের পর হত্যা, চাঞ্চল্যকর রহস্য উদ্ঘাটন

১০

পাপন সিংয়ের গোলে জয়ে বছর শেষ করল বাংলাদেশ

১১

নদীতে ভেসে উঠল কলসি বাঁধা অজ্ঞাত লাশ

১২

করপোরেট অ্যামেচার ক্রিকেট ফাইনালে বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনী

১৩

‘বিএনপি ক্ষমতায় এলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের খেলার মাঠগুলো দৃষ্টিনন্দন হবে’

১৪

ঐতিহ্য প্রকাশিত ‘আবিদ আজাদ-রচনাবলি’র প্রকাশনা অনুষ্ঠান

১৫

বায়ুদূষণ রোধে বিয়ের অনুষ্ঠান বন্ধের প্রস্তাব

১৬

অর্থনৈতিক সংকটে লিওঁ, লিগ ২-এ সাময়িক অবনমন

১৭

চবিতে শিবিরের ‘ফ্রেশার রিসিপশন অ্যান্ড ক্যারিয়ার গাইডলাইন প্রোগ্রাম’ অনুষ্ঠিত

১৮

‘আগামীর রাজনীতি কী হবে তার সিদ্ধান্ত দেবে জনগণ’

১৯

সশস্ত্র বাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার সময় বাড়ল

২০
X